ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

হুমকিতে সেন্টমার্টিন

প্রকাশিত: ২১:১৩, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

হুমকিতে সেন্টমার্টিন

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের শেষ সীমানায় অবস্থিত সেন্টমার্টিন একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপটি আয়তনে খুব ছোট, তদুপরি জোয়ারের সময় প্রতিদিন একটি অংশ জলমগ্ন হয়- যে অংশটি ছেঁড়া বা নারকেল দ্বীপ হিসেবে খ্যাত। মনোরম ও নয়নাভিরাম সেন্টমার্টিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় দ্বীপও বটে। প্রতিবছর দেড় লাখের বেশি পর্যটক দ্বীপটি ভ্রমণ করে থাকেন। দ্বীপটির নিয়মিত অধিবাসী ১০ হাজারের বেশি, যাদের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎসও এটি।

তবে ক্রমাগত পর্যটকদের ভিড়ে সমূহ হুমকিতে রয়েছে সেন্টমার্টিন। বর্তমানে দ্বীপটিতে পর্যটকদের সামলাতে ছোট-বড় অসংখ্য হোটেল, মোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। বাইরে থেকে হাজার হাজার টন লোহা, ইট, সিমেন্ট, বালু ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী সেখানে নিয়ে গিয়ে নির্মিত হয়েছে এসব। যেগুলোর চাপ ও ভার সামলাতে সেন্টমার্টিনের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঘটেছে। এর বাইরে রয়েছে অগণিত পর্যটকের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণের কঠিন ও তরল বর্জ্য। যার ফলে প্রতিদিন ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ঘটছে দ্বীপটির ও সন্নিহিত সাগরের। এর ফলে, সেন্টমার্টিনের প্রবাল প্রাচীর, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য এমনকি সীমিত পরিমাণে থাকা বৃক্ষরাজিও প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। 
এর পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, যা শুধু সেন্টমার্টিন নয়, বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য রীতিমতো ঝুঁকি ও হুমকির সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে সরকারিভাবে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ১৭৪৩ কিলোমিটার এলাকা মেরিন প্রোটেকটিভ এরিয়া ঘোষণা করা হয়। বাস্তবে কার্যকর হয়নি কিছুই। ফলে, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি শুধু প্রবালশূন্য নয়, এক সময় পুরো সেন্টমার্টিন তলিয়ে যেতে পারে বঙ্গোপসাগরের গর্ভে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সায়েন্স জার্নালে এমন উদ্বেগজনক গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্বীপটিকে রক্ষা করতে হলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সমূহ ঝুঁকিতে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। প্রতিবছর একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, ঝড়-ঝঞ্ঝা-অতিবৃষ্টি-বন্যা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রায়ই আঘাত হানে, বিশেষ করে দেশের সুবিস্তৃত সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে। এর অনিবার্য প্রভাব পড়ে সারাদেশেই। সর্বশেষ উদাহরণ অসময়ের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিত্রাং। এর বাইরেও রয়েছে অতিবৃষ্টি, বন্যা, অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি। দেশে চলতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৭১ লাখ মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাস্তুচ্যুত অসহায় মানুষের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে এক কোটি ৩৩ হাজারের বেশি। 
মিসরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও উঠে এসেছে বিষয়টি। জাতিসংঘ আয়োজিত ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭) শেষ পর্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠনের বিষয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে। প্যারিস চুক্তির ভিত্তিতে উন্নত বিশ্ব বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানেও তাদের তীব্র অনীহা।

ফলে, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে এবারের সম্মেলনে ন্যায্যতার জন্য তিনটি দাবি তোলা হয় জোরালোভাবে। প্রথমত, কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো এবং তা অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড গঠন। তৃতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান, যেটি এবারে স্থান পেয়েছে। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ এবারে জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় কয়েক মিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ইতোমধ্যে। তবে হুমকিতে থাকা দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে রক্ষার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।

×