ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০২৪

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ক’দিন। লড়াই এখন তুঙ্গে। কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ইতোমধ্যে আগাম ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটিতে নিজস্ব ভোটিং পদ্ধতি রয়েছে। পোস্টের মাধ্যমে ভোট বা সশরীরে গিয়ে আগাম ভোট, নির্বাচনের দিন ভোটÑ এ তিনটি পদ্ধতিতেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা  রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক পরিবার আছে যারা আগাম ভোট দেওয়াকে পারিবারিক ঐতিহ্য বলে বিবেচনা করেন। 
নভেম্বর নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা ও ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার লক্ষ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়ছেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। যুদ্ধ, মহামারি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কোনো আন্তর্জাতিক সংকটের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী ভূমিকা রাখছেন, তার প্রভাব অপরিসীম। এ কারণেই প্রতি চার বছর পর পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তখন এর ফল কী হবে, তা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই তৈরি হয় এক ব্যাপক আগ্রহ।

এটাও ঠিক যে, এই নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা কীভাবে কাজ করে তা অনেকেই হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারে না। আর এ জন্যই রাজ্যভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট কী এবং কীভাবে কাজ করে বা ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ কাকে বলেÑ এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছি লেখায়। 
প্রতি চার বছর পর পর আমেরিকায় নির্বাচন হয়ে থাকে এবং নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পর যে মঙ্গলবার পড়েÑ সেদিনই ভোটগ্রহণ হয়। সব সময় এভাবেই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হয়ে আসছে। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের ৫ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। এখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে প্রভাবশালী দল মাত্র দুটিÑ রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট।

সাধারণত এই দুটি দলের যে কোনো একটি দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসেন। অবশ্য ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দলÑ যেমন লিবার্টারিয়ান, গ্রীন, ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টিÑ তারাও কখনো কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করেন। রিপাবলিকান পার্টি একটি রক্ষণশীল দল হিসেবে পরিচিত। এ দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ডাব্লিও বুশ ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। অপরদিকে ডেমোক্র্যাট দল তুলনামূলকভাবে উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। উল্লেখযোগ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন জন এফ কেনেডি, বিল ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা।  
বর্তমানে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বয়স ৮০ বছর। বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয় বলে ২০২৪ সালে পুনর্নির্বাচনী প্রস্তুতিও তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত জুলাইয়ে মি. বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। মূলত এরপর থেকেই ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলকান, উভয় শিবিরেই নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে।

তবে প্রেসিডেন্ট কে হবেন, সেটি নির্ধারণ হবে আগামী পাঁচই নভেম্বরের নির্বাচনে। ভোটাররা চার বছর মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। এ নিয়ে প্রত্যাশীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিশ্ববাসীর উৎকণ্ঠা যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। 
যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বের কাছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃত। গণতন্ত্রের পুরোধা, ঐতিহ্যের প্রতীক, গর্বিত মুরব্বি আর উপদেশদাতা যুক্তরাষ্ট্র। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশটির নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। তিনি নির্বাচিত হন ইলেকটোরদের ভোটে। সাধারণ নাগরিকরা ইলেকটোরদের নির্বাচন করে। 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের মোট আসন সংখ্যা ৫৩৮টি। এই নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল আসন অর্জন করতে হবে। প্রতিটি রাজ্যের জন্য ইলেকটোরাল আসন সংখ্যা রাজ্যটির জন্য বরাদ্দকৃত সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের মোট আসন সংখ্যার সমান। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনা পদ্ধতি দুটি।

একটি হলো মাথাপিছু ভোট, যাকে বলে পপুলার ভোট। অপরটি হলো রাজ্যভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কিন গণতন্ত্রে পপুলার ভোটের চেয়ে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সর্বাধিক পপুলার ভোট অর্জন করলেও তাকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট (২৭০) অর্জন করতে সক্ষম হলেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দান করে।
উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী আল গোর ওই সময়ে সর্বাধিক পপুলার ভোট পেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ, তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলের জর্জ বুশ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন ২৭১টি। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১টি বেশি। আর এতেই তিনি আল গোরকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন।

২০১৬ সালেও তাই হয়েছিলÑ হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের চাইতে ৩০ লাখ পপুলার ভোট বেশি পেলেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ট্রাম্প মোট ৩০৪টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পান, যা ছিল হিলারি ক্লিনটনের পাওয়া ২২৭টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের চেয়ে অনেক বেশি। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ভাষা দুটি। একটি ইংরেজি অপরটি হলো স্প্যানিশ। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্ম এবং বহু বর্ণের সংমিশ্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। এত ভাষাভাষীর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাই একে ‘ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যান্ট’ বলা হয়। বিশ্বের এই বহুজাতিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই এই বিশেষ পদ্ধতি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের অন্তর্ভুক্ত।

প্রেসিডেন্ট ৪ বছর, সিনেটর ৬ বছর এবং কংগ্রেসম্যান দুই বছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে দুটি করে সর্বমোট ১০০টি সিনেটর পদ। সিনেটর পদ নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু কংগ্রেসম্যান পদ জনসংখ্যাভিত্তিক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আনুপাতিক হারে কংগ্রেসম্যান বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে গোটা আমেরিকায় ৪৩৫টি কংগ্রেসম্যান পদ এবং ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। এই ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট মানেই ১০০ সিনেটর এবং ৪৩৫টি কংগ্রেসম্যান। উল্লেখ্য, ৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ওয়াশিংটন ডিসি থেকে  নির্ধারণ হয়। 
বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বের সব দেশের জন্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত  নির্বাচনের ফল পরবর্তী ৪ বছর বিশ্বের সব দেশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কমবেশি প্রভাব ফেলে। তবু আমেরিকার জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সর্বশীর্ষে।

আজকের এ আমেরিকার উন্নয়নে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল অভিবাসীরই বিন্দু বিন্দু শ্রম, ঘাম ও যথেষ্ট ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে- এ কথা অনস্বীকার্য। আগামীতে যিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন তার গতিশীল নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রত্যাশা করছি।


লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×