ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

হযরত বেলাল (রা.) এর প্রথম আজান

মনিরুফ ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

হযরত বেলাল (রা.) এর প্রথম আজান

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইসলাম মুসলমানকে জামাআত বা সংঘবদ্ধ সুষ্ঠু জীবন পরিচালনে উদ্বুদ্ধ করার প্রশিক্ষণরূপে সংঘবদ্ধ নামাজের ওপর অত্যন্ত বেশি গুরুত্বারোপ করে। এই কারণে মুসলমান যখন গৃহে বা মাঠে নামাজ অনুষ্ঠানে উদ্যত হয়, তখন তার পক্ষে অনুমোদিতভাবে উচ্চৈঃস্বরে আজান দেওয়া শ্রেয়, যাতে ইচ্ছুক শ্রোতাগণ নামাজে যোগদান করতে পারে। মসজিদে জুমা এবং প্রাত্যহিক পাঁচওয়াক্ত নামাজের সময় আজান অবশ্যই কর্তব্য। 
আজান অর্থ ঘোষণা। শুক্রবারের জুমার সালাত ও দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামাজে যোগদানের আহ্বানসূচক বাক্য সমষ্টির পারিভাষিক নাম আজান। হাদিস অনুযায়ী মদীনা হিজরতের (এক বা দুই বছর) পর নবী করীম (সা.) মুসলিমদের নিকট নামাযের সময় ঘোষণার প্রকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে সাহাবীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। 
 কেউ নামাজের সময় আগুন জ্বালানোর প্রস্তাব করলেন। কেউ বললেন, শিংগা ফুকবার বা নাকূস বাজাবার কথা। (এক খ- লম্বা কাঠকে তৎসংযুক্ত আর একখ- কাঠ দ্বারা আঘাত করলে যে শব্দ হয় সে শব্দে প্রাচ্যের খ্রিস্টানরা তখনকার দিনে প্রার্থনার সময় ঘোষণা করত এবং একে নাকূস বলা হতো)।
তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়িদ (রাদি.) নামক জনৈক সাহাবী বলেন যে, তিনি স্বপ্নে এক ব্যক্তিকে মসজিদের ছাদে উঠে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে মুসলমানদের সালাতের বা নামাজে আহ্বান করতে দেখেন। হযরত উমর (রাদি.)ও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন, এরূপ বর্ণনা হাদিসে পাওয়া যায়।

তিনিও আহ্বান প্রণালীর প্রস্তাব করেন। সবাই তাতে সম্মত হওয়ায় নবী করীম (স.) এর আদেশে এই আযান প্রবর্তিত হয়। (বিস্তারিত দেখুন সহীহ মুসলিম কিতাবুস সালাত)। তখন থেকে বিলাল (রাদি.) আযান ধ্বনির মাধ্যমে মুমিনগণকে সালাতের আহ্বান জানাতেন এবং অদ্যাপি নামাজের সময় সেই আজানই দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, মহানবী হযরত রাসূলে কারীমের (সা.) নির্দেশে হযরত বিলাল (রাদি.) সর্বপ্রথম যে দিন আজান দেন সে তারিখটি ছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দ ১২ অক্টোবর। জোহর ওয়াক্তের আজান দানের মাধ্যমে তিনি সেদিন আজান ব্যবস্থার শুভ উদ্বোধন করেন। বেলাল (রা.) হলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। বিলালের  উচ্চ ও হৃদয়গ্রাহী আজান ধ্বনি শুনে মদীনার নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কেউ ঘরে স্থির থাকতে পারতো না।

মসজিদে তাওহীদের ধারকÑবাহকদের ভিড় জমে উঠলে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.) দরজায় গিয়ে আওয়াজ দিতেন: ‘হাইয়ালাস সালাহ, হাইয়ালাল ফালাহ, আস্সালাহ ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওহে আল্লাহর নবী নামাজ উপস্থিত।’ 
রাসূল (সা.) বেরিয়ে আসতেন, বিলাল তাকবীর দিতেন। কোনো দিন হযরত বিলাল মদীনায় উপস্থিত না থাকলে হযরত আবু মাহযুরা  (রাদি.) এবং হযরত আমর ইবনে উম্মে মাকতুম (রাদি.) তার দায়িত্ব পালন করতেন। 

বিলাল (রাদি.) সাধারণত সুবহে সাদিক হওয়ার আগেই ফজরের আজান দিতেন। এ কারণে সকালে দু’বার আজান দেওয়া হতো। শেষের আজান দিতেন হযরত আমর ইবনে উম্মে মাকতুম (রাদি.)। এজন্য রমজান মাসে হযরত বিলালের (রাদি.) আজানের পর পানাহার জায়েজ ছিল। 
রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর হযরত বিলাল নবীজীকে (সা.) হারানোর বেদনায় মদীনা ছেড়ে চলে যান। বসবাস করতে থাকেন সিরিয়ায়। একদিন স্বপ্নে দেখলেনÑ রাসূল (সা.) তাকে বলছেন, বিলাল, এমন নিরস জীবন আর কতকাল? আমার জিয়ারতের সময় কি তোমার এখনো হয়নি? এ স্বপ্ন তার প্রেম ও ভালোবাসার ক্ষত আবার তরতাজা করে দেয়। তখনই তিনি মদীনা রওয়ানা হলেন এবং পবিত্র রওজা মুবারকে হাজির হয়ে জবাই করা মোরগের মতো ছটফট করতে লাগলেন। 
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কলিজার টুকরো হযরত হাসান ও হুসাইন (রাদি.) কে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকেন। তারা দু’জন সে দিন সকালে ফজরের আজান দেওয়ার জন্য হযরত বিলালকে (রাদি.) অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। 
সুবহে সাদিকের সময় মসজিদে নববীর ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলেছিলেন। আর সে ধ্বনি মদীনার অলিতে গলিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল। তার সে আযান ধ্বনি শুনে মদীনার জনগণ তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলতে লাগল। 
তিনি যখন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ বলতেন, তখন মদীনার নারী-পুরুষ সকলেই অস্থিরভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। বর্ণিত আছে, এমন ভাববিহ্বল দৃশ্য মদীনায় আর কখনো দেখা যায়নি। 
এ নিষ্ঠাবান রাসূল প্রেমিক সাহাবী হিজরী ২০ সনে প্রায় ষাট বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দামিশকের ‘বাবুস সাগীরের’ কাছেই তাকে দাফন করা হয়। আজকের যুগেও আজান আছে, কিন্তু বিলালের সে আন্তরিক অভিব্যক্তি ও প্রেমের সুধা নেই। আযান ও সালাতের মর্মকে আমাদের হৃদয় মনে আবার স্থান দিতে হবে। 

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×