ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

বাবুল কান্তি দাশ

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

সভ্যতার আধুনিকায়নে পলিথিনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মানুষ। ক্রমে ক্রমে জীবনের অন্যতম এক অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে পলিথিন। ব্যবহার্য সামগ্রীর বিশাল অংশ জুড়ে প্লাস্টিকের সামগ্রী। যা অজান্তেই ক্ষতি করছে প্রকৃতি ও মানুষের ওপর। মাত্র কয়েক দশক পিছিয়ে গেলে লক্ষ্য করা যায়, অ্যালুমিনিয়াম ক্যান বা কাচের বোতলে দুধ আসত বাড়িতে, কাঁচামাল ও মাছের বাজারের জন্য বরাদ্দ থাকত আলাদা পাটের ব্যাগ।

বাজার-দোকানে গেলেও সঙ্গী করা যায় এ ধরনের পাটের বা কাগজের ব্যাগ। টিনের কৌটোয় দাঁতের মাজন বা পাউডারের সঙ্গে এই প্রজন্মের মধ্যবয়স্করা কিন্তু ছোটবেলায় এক যুগ পার করেছে। সেই অভ্যেস ফিরিয়ে আনলেই অনেকাংশে এই প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু বাড়িতে প্রাথমিক স্তরে যেমন কাজ শুরু করতে হবে, তেমনই সরকারের তরফেও প্লাস্টিক দূষণ রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। 
পলিথিন-প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ না করলে এই দূষণ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। প্লাস্টিক উৎপাদনে রাশ না টেনে জনগণকে প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলে লাভ নেই। তা অনেকটা বহুছিদ্র পাত্রে জল ভরার শামিল। দৈনন্দিন জীবন যাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা প্লাস্টিক পানি, বায়ু এবং মাটিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে, সকল পর্যায়ে বসবাসকারী অসংখ্য প্রাণী-উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে।

মাত্রাহীন প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং তার আবর্জনা শহর নগর গ্রাম প্রতিটি জায়গায় চরম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে যা বাস্তুতন্ত্রকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আগে যেখানে কাপড়ের ব্যানার, টিনের বিলবোর্ড ছিল, আধুনিকায়নের ফলে সেই জায়গা  দখল নিয়েছে প্লাস্টিক। শহরের প্রতিটি জায়গায় দেদার পড়ে থাকে ডিজিটাল ব্যানার। যা প্রভাব ফেলছে পরিবেশের ওপর। পলিথিন হচ্ছে অপচনশীল। কার্বনঘটিত যৌগ ইথালিনের অনেক অণুকে পলিমারাইজ করে তৈরি করা হয় পলিমার।

এই যৌগে দুটি করে হাইড্রোজেন অণুর সঙ্গে একটি করে কার্বন পরমাণু সংযুক্ত থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কার্বনঘটিত যৌগ হওয়া সত্ত্বেও কেন বারবার প্লাস্টিক বা পলিথিনকে বর্জন করার প্রস্তাব উঠছে। কেনই বা তাকে প্রাণীদের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বলা হচ্ছে? উত্তরটা, আমাদের সকলেরই জানা। প্লাস্টিক একটি ‘নন বায়োডিগ্রেডেবল’ দ্রব্য।

অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে তাকে ধ্বংস করা অসম্ভব। তার কারণেই যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে এই প্রকৃতিতে মিশছে তা মাটি বা আলোর মতো প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। বিপদ ঘটাচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের। সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক ক্ষতি করছে মানব শরীরে। বিভিন্ন পরীক্ষা ও গবেষণায় দেখা যায়, মানব শরীরে পাওয়া যাচ্ছে পেট প্লাস্টিক যা দিয়ে তৈরি হয় পানির বোতল, কারও শরীরে মিলেছে পলিস্টেরাইন, যা থাকে খাবারের কন্টেনারে।

আবার কিছু মানুষের রক্তে মিলেছে পলিইথাইলিন, যা দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিকের ছোট ক্যারি ব্যাগ। এক-এক জনের শরীরের রক্তে আবার দু’-তিন রকমের প্লাস্টিকও মিলেছে। কী ভাবে তা রক্তে প্রবেশ করছে, এখনো গবেষণাসাপেক্ষ। তবে রক্তে এক বার মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেলে, তা বিভিন্ন অর্গানে যে সহজে পৌঁছে যেতে পারে, তা বোঝা কঠিন নয়। ডেকে আনতে পারে নানাবিধ রোগব্যাধি, যা হতে পারে প্রাণঘাতী। 
প্লাস্টিক দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর জায়গায় রয়েছে শিশুরা। কারণ গবেষণায় এ-ও স্পষ্ট যে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাচ্চাদের মলে প্রায় দশগুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে তাদের শরীরেও ব্যাপক হারে প্রবেশ ঘটছে এই বিষাক্ত বস্তুর। শুধু একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধ হলেই কি আমরা প্লাস্টিকের কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাব?

প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের দিকেও নজর ঘোরানো দরকার। এক হিসাব অনুযায়ী, মোট ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৪৩ শতাংশ পণ্যসামগ্রী মোড়কের কাজে ব্যবহার হয়। এই প্লাস্টিকও কিন্তু দ্বিতীয় বার ব্যবহার করা যায় না। তাই প্লাস্টিক বর্জন করি, পাটজাত সামগ্রী ব্যবহারে মনোনিবেশ করি।

বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম থেকে

×