ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম হয়েছে। শহরাঞ্চলে মাথাপিছু চাল গ্রহণের পরিমাণ ২৮৪ দশমিক ৭ গ্রাম, যা জাতীয় গড়  থেকে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ১৭ কোটির মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় ১ কোটি টন।

সব মিলে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। তাহলে চাল আমদানি করতে হয় কেন? বৃদ্ধির প্রায় দ্বিগুণের বেশি হারে আমাদের ধান উৎপাদন বৃদ্ধি  পেয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্ত। 
চালের উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েই গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চালের উৎপাদন যথেষ্ট ভালো। চাহিদার চেয়ে কমপক্ষে ৫০ লাখ টন  বেশি। ফলে আমদানির দরকার নেই। বাস্তবে চাল উদ্বৃত্ত থাকার পরও দেশের বাজারে দফায় দফায় দাম বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাবে বাংলাদেশে চলতি বছর চাহিদার তুলনায় চালের উৎপাদন কিছুটা কম।

গমের আমদানি কমে যাওয়ায়  বেড়েছে চালের চাহিদা। ঢাকার বাজারে কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ‘রশিদরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে’। কুষ্টিয়ার রশিদ, যিনি আগে আওয়ামী লীগের হানিফের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। সেই থেকে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। তিনি মিল মালিকদের নেতাও বটে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, চলতি অর্থবছরে মোট ৪  কোটি ১২ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে। এর মধ্যে  বোরো ২ কোটি ৯ লাখ টন, আউশ ৩০ লাখ টন ও আমন ১ কোটি ৭০ লাখ টন। দেশে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ টনের কাছাকাছি। সেই হিসাবে দেশে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ প্রতি বছর ৬০/৭০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে বলে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়। 
 বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ চীন। দ্বিতীয় স্থানে ভারত। আর গত ৫ বছরে অষ্টম স্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মিসর ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন দেখানো হয় ৩৬ লাখ টন, আর চাহিদা দেখানো হয় ২৬ লাখ টন (সূত্রÑ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)।

অথচ বিশ্বে পেঁয়াজ আমদানিতে শীর্ষে এখন বাংলাদেশ, আর দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র। তবু গত পাঁচ বছর ধরে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। এরপরই ভারত ও চীন। বর্তমানে এক কেজি পেঁঁয়াজের দাম ১২০ টাকা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল এক হাজার ৭১১ কোটি পিস, যা বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয় দুই হাজার ৩৩৮ কোটি পিস। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৪০০ কোটি পিস। ডিমের উৎপাদন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দামও। বর্তমানে প্রতি হালি ডিমের দাম ৬০ টাকা।
এবার আসা যাক বর্তমান বাজার মূল্যে। টিসিবি গত ৫ সেপ্টেম্বর চালের মূল্য দেখিয়েছে প্রতি কেজি (সরু) ৮০ টাকা, মাঝারি ৬০ টাকা আর মোটা ৫৫ টাকা। আটা ৫৫ টাকা, ময়দা ৬০ থেকে ৭০ টাকা। সয়াবিন (লুজ) ১৫৫ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৮১০ টাকা। ডাল (মসুর) ১২০ টাকা। পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১২০ টকা, রসুন ২২০ টাকা। গরুর গোস্ত প্রতি কেজি ৮০০ টাকা আর খাসি ১২০০ টাকা। আলু ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। টিসিবির তথ্যমতে, সব ভোগ্য পণ্যেও দাম বেড়েছে বা বাড়ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৪.১ শতাংশ বা ৩.৯২ কোটি মানুষ ‘বহুমাত্রিক’ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। এ ধরনের দারিদ্র্যের কারণেই মোট জনসংখ্যার ২৪.৩ শতাংশ মানুষ রয়েছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের প্রকৃত সংখ্যা কত তার সঠিক সংখ্যাটা অজানাই রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে নাকি গরিব মানুষের সংখ্যা কমেছে। বিষয়টি হাস্যকর। যেখানে বর্তমান জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি, সেখানে তারা বলেছিল ১৬ কোটি ৪০ লাখ। কর্মক্ষম ৪২ শতাংশ মানুষ এখন কর্মহীন। অপরদিকে বেকারত্বের হার তো বাড়ছেই। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষিত বেকার প্রায় ৬২ লাখ।
এদিকে উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশ দেশের যুবসমাজ। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না। গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ নেই ২৯.৮ শতাংশ তরুণের।
বিগত সরকারের দুঃখজনক অমনোযোগ আমার কাছে বরাবরই অগ্রহণযোগ্য ছিল। অন্তর্র্বর্তী সরকার ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বলছি, বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেল’। এই মডেলের মূল কথা হলো, আয়বৈষম্য নিরসনকারী অবস্থান গ্রহণ করলে কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে যে ধারণা সাইমন কুজনেৎস অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্ব চালু করেছিলেন, সেটা একটা মারাত্মক ‘ভুল ধারণা’, যা তিনি জেনেই করেছিলেন। বেকারত্ব, দারিদ্র্য বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। সাধারণ মানুষ এখানে অসহায়।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এখন গড়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশে প্রায় ১১ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাজার সিন্ডিকেট ভাঙ্গার কি কোনো ব্যবস্থা নেই? আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন এখন ৭০/৭২ টাকা, এক কেজি চিনি ৮২/৮৫ টাকা। আর আমরা খাচ্ছি প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকায় আর সয়াবিন (লুজ) ১৭০-১৮০ টাকায়, আর বোতলজাত ২০০ টাকায়। তাহলে কি এই অবস্থা চলতে থাকবে?

সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কি কোনো মতেই বেঁচে থাকবে আর ক্ষুধার জ্বালা সাইবে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কাজ চালাচ্ছে। ক্ষুধার্ত মানুষ আশা করেছিল, ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে। উল্টো বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ীরা আপন মনে পণ্যের দাম বাড়িয়েই চলেছেন।  কাজেই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হবে জরুরিভিত্তিতে।


লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারাম্যান- ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×