ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ॥ মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ॥ মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ

যক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এর সম্ভাব্য ফল নিয়ে ততই বিচার বিশ্লেষণে মেতে উঠছে পত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ। এক্ষেত্রে মূল আলোচ্য বিষয় পপুলার ভোট বা জনপ্রিয়তার নিরিখে ট্রাম্প বা হ্যারিসের কে কতটা এগিয়ে আছেন আর ইলেক্টোরাল ভোটের ক্ষেত্রে কার অবস্থান কেমন, সেটি! আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্রে পপুলার ভোটের চেয়েও অনেক সময় ইলেক্টোরাল সিট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নির্বাচনের ফল নির্ধারণে।

তবে, আজকের লেখায় আমি চেয়েছি এ দুটো বিষয়ের বাইরে গিয়ে মার্কিন জনগণের ভোটের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে এমন বিষয়গুলো তুলে ধরতে। অর্থনীতি, অভিবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং জাতিগত বৈষম্য থেকে শুরু করে, ভোটারদের সামনে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা তাৎক্ষণিক উদ্বেগ এবং দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক বিভাজনের প্রতিফলন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নির্বাচনটি যেমন প্রতিযোগিতামূলক, তেমনি অনিশ্চিত হতে চলেছে বলে পূর্বাভাস দেখে মনে হচ্ছে।

যদিও রিপাবলিকান প্রার্থী কমলা হ্যারিস বর্তমানে সব জরিপেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন, তাদের ব্যবধান গত কয়েক সপ্তাহে অনেকটাই কমে এসেছে। এমতাবস্থায় ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পর্দার পেছনের মূল কারণগুলো বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আমি আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রভাবশালী পত্রিকার গত কয়েক সপ্তাহের নানা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেছি এবং সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমার তথ্যভিত্তিক ধারণা আমার কলামের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

আমি যেসব প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বিশ্লেষণ করেছি, তার মধ্যে আছে চবি জবংবধৎপয ঈবহঃবৎ, টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষরভড়ৎহরধ উধারং, ইৎড়ড়শরহমং ওহংঃরঃঁঃরড়হ, ঊৎহংঃ ্ ণড়ঁহম, ঈযধঃযধস ঐড়ঁংব, ঞযব ঊপড়হড়সরংঃ প্রমুখ।  
বিশ্লেষণে এটি পরিষ্কার যে, বেশিরভাগ ভোটারের জন্য অর্থনীতি এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সাম্প্রতিক এক চবি জবংবধৎপয ঈবহঃবৎ-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮১% নিবন্ধিত ভোটার তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অর্থনীতিকে প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। মূল্যস্ফীতি, খাদ্যদ্রব্যের দাম, আবাসনের খরচ এবং চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা সর্বাধিক।

যেখানে দুটি প্রধান দলীয় প্রার্থীÑ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসÑ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করছেন। ট্রাম্পের সমর্থকরা, যারা প্রধানত কর্মজীবী শ্রেণির এবং বয়স্ক, তার নিয়মকানুনে কড়াকড়ি হ্রাস করা, কর কমানো এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাণিজ্যনীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতিতে সমর্থন জানিয়েছে। তার সমর্থকদের মধ্যে ৯৩% এই নীতি সমর্থন করছে, যারা অর্থনীতিকে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছে।

অপরদিকে, হ্যারিসের সমর্থকরা, যারা তুলনামূলকভাবে নানা বর্ণ, গোত্র ও ধর্মের অনুসারী এবং একইসঙ্গে তুলনামূলকভাবে তরুণ, তারা স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত করা, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো এবং বড় বড় কোম্পানি ও ধনী ব্যক্তিদের ওপর কর বাড়ানোর নীতিতে জোর দিচ্ছে। এই অর্থনৈতিক বিভাজন আমেরিকানদের আর্থিক ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বাড়তে থাকা মেরুকরণের প্রতিফলন।
অভিবাসন এবং সামাজিক ইস্যু নিয়েও আমেরিকানদের মধ্যে গভীর বিভাজন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের অন্যতম প্রধান ইস্যু হলো অভিবাসন, যেখানে নানাদলের ভোটারদের মনোভাব ভীষণভাবে ভিন্নরকম। ট্রাম্পের সমর্থকদের একটি বড় অংশ, প্রায় ৮২%, অভিবাসনকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখছে এবং কঠোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও অভিবাসন কমানোর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।

এটি ট্রাম্পের প্রচারের একটি কেন্দ্রীয় দিক, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও রক্ষণশীল মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে। অপরদিকে, হ্যারিস এবং তার সমর্থকরা জাতিগত সমতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য অভিবাসন আইনের সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। অনেক হ্যারিস সমর্থকদের জন্য, অভিবাসন স্বাস্থ্যসেবা, শ্রম অধিকার এবং জাতিগত বৈষম্যের মতো বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত।

এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আমেরিকান রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করতে আসা সাংস্কৃতিক বিভাজনকে প্রতিফলিত করে। এটি উল্লেখ করা জরুরি যে, রিপাবলিকান দল তাদের সুবিধামতো নানা প্রচারণায় হ্যারিসকে আফ্রিকান আমেরিকান, ইন্ডিয়ান আমেরিকান হিসেবে উপস্থাপন করছে, এসব অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীদের ভোট আদায় করার উদ্দেশ্যে।

আবার কমলা হ্যারিসের ইহুদি সংযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় নিয়েও একইভাবে সরব আছে। এক্ষেত্রে ট্রাম্প বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। কারণ, এর আগে হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করার সময় হিলারির সমর্থকদের মধ্যে এতটা বৈচিত্র্যময় বর্ণ, গোত্রের সমর্থন ছিল না। 
স্বাস্থ্যসেবা এবং গর্ভপাতের অধিকার হ্যারিস সমর্থকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এই নির্বাচনে। সুপ্রিম কোর্টের রো বনাম ওয়েড সিদ্ধান্ত বাতিলের পর এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যারিস সমর্থকদের একটি বড় অংশ, ৬৭% গর্ভপাতের অধিকারকে প্রধান ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করছে। যেখানে ট্রাম্প সমর্থকদের মাত্র ৩৫% এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

এই বিভাজন বিশেষ করে কম বয়সী এবং বেশি প্রগতিশীল ভোটারদের মধ্যে স্পষ্ট, যারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রজনন অধিকার নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গর্ভপাতের বাইরেও, স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার ভোটারদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। হ্যারিস সরকার গঠন করলে সাবসিডাইজড স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রাম, যেমনÑ মেডিকেয়ার ও সোশ্যাল সিকিউরিটি বিস্তৃত করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা কর্মজীবী শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। অপরদিকে, ট্রাম্প স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি হস্তক্ষেপ কমানোর জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন, যা গোঁড়া রক্ষণশীল ও ধনী সম্প্রদায়ের কাছে সমর্থন পাচ্ছে। 
জাতি, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি বিষয়ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটারদের পছন্দকে প্রভাবিত করতে বড় ভূমিকা রাখছে। হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন উপভোগ করছেন, যেখানে ৭৯% কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার এবং একটি উল্লেখযোগ্য হিস্পানিক ভোটার সামাজিক ন্যায়বিচার এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক তার নীতির সঙ্গে একমত।

অপরদিকে, ট্রাম্পের সমর্থন প্রধানত শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে তার সমর্থন ৫৫%। ভোটারদের সমর্থনের এই জাতিগত বিভাজন পুলিশ সংস্কার, দাসপ্রথার উত্তরাধিকার এবং আমেরিকান সমাজে অভিবাসীদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তৃত বৈষম্যের প্রতিফলন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন উল্লেখ করেছে যে, ট্রাম্পের জাতি এবং অভিবাসন নিয়ে বক্তৃতা, বিশেষ করে হ্যারিসের জাতিগত পরিচয় নিয়ে সমালোচনা নির্বাচনি মেরুকরণ আরও বাড়িয়েছে।

এই জাতিগত বিভাজনমূলক বিষয়গুলো যেসব রাজ্যে প্রতিযোগিতা বেশি যেমনÑ ওহায়ো, পেনসেলভিনিয়া কিংবা উইসকনসিনে নিষ্পত্তিমূলক হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। যেখানে উভয় প্রার্থীকে ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর কাছে ভোটের জন্য আবেদন জানাতে হবে। উল্লেখ্য, গত এক দশকে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেই ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান কমিয়ে এনেছেন এবং একটিতে বেশি জনপ্রিয় হিসেবে জিতেও গেছেন। 
বৈদেশিক নীতি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। বাড়তে থাকা নানা উদ্বেগ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নির্বাচনে আধিপত্য করছে। তবু বৈদেশিক নীতি চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষিতে বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। ট্রাম্প এবং হ্যারিস উভয়েরই বৈদেশিক নীতি এজেন্ডা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

চীনের প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব এবং ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিষয়ে তার সমালোচনা রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যাদের অনেকেই বিদেশী সহায়তা কমানো এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে কঠোর মনোভাবের পক্ষে। অপরদিকে, হ্যারিসের সমর্থকরা তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং বহুপক্ষীয়তায় সমর্থনকে পছন্দ করছে। চবি জবংবধৎপয-এর একটি সমীক্ষায় দেখায় যে, ৮১% রিপাবলিকান চীনকে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখছে।

যেখানে মাত্র ৬০% ডেমোক্র্যাট একই মনোভাব পোষণ করে। এই বৈদেশিক নীতির বিভাজন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকা নিয়ে বৃহত্তর দলীয় মতপার্থক্য প্রতিফলিত করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লেখার শেষ অংশে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব। 
গণমাধ্যমের প্রভাব এবং অন্যান্য পক্ষের প্রার্থীদের প্রভাব ২০২৪ সালের নির্বাচনে একটি অতিরিক্ত অনিশ্চয়তার স্তর যোগ করেছে। রবার্ট কেনেডি জুনিয়রের মতো ব্যক্তিত্ব, যার পরিবেশবাদী এবং ভ্যাকসিনের প্রতি সংশয়ী মনোভাব অনেকেরই সমর্থন পাচ্ছে, সেটি ট্রাম্প এবং হ্যারিস উভয়ের কাছ থেকে ভোট টেনে নিতে পারে।

একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে অন্যান্য দলের প্রার্থীরা নির্ধারণী ভূমিকা রাখতে পারে, যেমনÑ রালফ নেইডার ২০০০ সালের নির্বাচনে করেছিলেন। এছাড়াও, ভাইরাল বিষয়বস্তু এবং ২৪ ঘণ্টার সংবাদ দ্রুত ভোটারদের উপলব্ধিকে উস্কে দিচ্ছে। টঈ উধারং উল্লেখ করেছে যে, গণমাধ্যমের প্রভাব অস্থির ভোটারদের মতামত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যেখানে আইনি লড়াই, বয়স নিয়ে উদ্বেগ এবং নির্বাচনি নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা সাধারণ, সেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অবমূল্যায়ন করা যাবে না।

আইনি অনিশ্চিত বিষয়াদি যেমনÑ ট্রাম্পের আইনি ঝামেলাÑ জানুয়ারি ৬ তারিখের অস্থিতিশীলতা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত একাধিক অভিযোগÑ নির্বাচনে অনিশ্চয়তার একটি স্তর যোগ করেছে। এই বিতর্ক সত্ত্বেও ট্রাম্পের সমর্থকরা অবিচল থেকেছেন। 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মধ্যপ্রাচ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, উভয় প্রার্থীÑ ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসÑ মধ্যপ্রাচ্যে ভিন্ন ভিন্ন নীতি ও অবস্থান তুলে ধরেছেন। চলমান সংকটগুলো, বিশেষ করে ইরান, সৌদি আরব এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত, পরিবর্তিত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ওপর নির্ভর করে অগ্রসর হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের মেয়াদে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছিলেন এবং ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। পুনর্নির্বাচিত হলে, ট্রাম্প সম্ভবত এই কঠোর নীতিকে আরও জোরালো করবেন। ইরানের অর্থনৈতিক চাপে থাকা অবস্থায়, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হলে, এ অঞ্চলে আরও সংঘাতের সম্ভাবনা থাকবে।

বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে মার্কিন-ইরান প্রভাব বিস্তারের সংঘাত বৃদ্ধি পেতে পারে?। অবশ্য ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপন, বিশেষত আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে। ট্রাম্প এবার নির্বাচিত হলে এই ধরনের চুক্তি আরও বাড়ানো হতে পারে, যা ইসরাইল এবং কিছু আরব দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে পারে।

এছাড়া ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, বিশেষত অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে। অন্যদিকে তার প্রশাসন মানবাধিকার ইস্যুতে নীরব ছিল, বিশেষ করে ইয়েমেনের যুদ্ধের মতো বিষয়গুলোতে। পুনঃনির্বাচিত হলে, সৌদি আরব এই সম্পর্কের সুবিধা নেবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে। অপরপক্ষে হ্যারিস প্রশাসন ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করতে পারে এবং পারমাণবিক চুক্তিতে (জেসিপিওএ) ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

এটি ইরানের অর্থনৈতিক সংকট কমাতে সহায়ক হতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা হ্রাস করতে পারে। তবে, এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল হবে এবং ইসরাইল বা সৌদি আরবের মতো মার্কিন মিত্রদের উদ্বেগের মুখোমুখি হতে পারে?। বিশেষত বর্তমানে ইসরাইল ও ইরান মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় হ্যারিস প্রশাসন ইসরাইলকে দিয়ে ইরানকে নিষ্ক্রিয় করার একটা চেষ্টা করতে পারে।

হ্যারিসের নীতি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি অধিক সংবেদনশীল হবেÑ এটি ভাবার কোনো কারণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তবে ইসরাইল বল প্রয়োগের মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিনকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পর লোক দেখানো দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের দিকে জোর দিলেও দিতে পারে। তবে ক্ষমতায় এলে হ্যারিস সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলোর বিরুদ্ধে আরও কড়া নীতি গ্রহণ করতে পারেন। সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি এবং অন্যান্য সহযোগিতায় মানবাধিকার শর্ত যুক্ত হতে পারে, যা সৌদি আরবের নীতির পরিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষত ইয়েমেন যুদ্ধের মতো ইস্যুতে।

ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য পরিচিত এবং তার আগের প্রশাসন রাশিয়ার বিষয়ে একাধিকবার নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে। ট্রাম্প ২০২৪ সালে পুনরায় নির্বাচিত হলে, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন বা রাশিয়ার প্রতি আরও সহানুভূতিশীল নীতি গ্রহণ করতে পারেন। তিনি আগেও ন্যাটো এবং ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা তার দ্বিতীয় মেয়াদে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন কমাতে পারে। এটি নিশ্চিত যে, মার্কিনি সহায়তা কমে এলে রাশিয়া-ইউক্রেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা ও ধ্বংসযজ্ঞ অনেকটাই কমে আসবে।

কেননা, এ সকল অঞ্চলকে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী অস্থিতিশীল রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত ডেমোক্র্যাট দলের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। ট্রাম্প ন্যাটোকেও প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছেন, যা ইউক্রেনের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে। কারণ, মার্কিন নেতৃত্ব ছাড়া ন্যাটোর সমর্থন দুর্বল হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন নিশ্চিতভাবেই ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা হ্রাস করবে। কারণ, তিনি আগেই এ ধরনের সহায়তার বিরুদ্ধে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এটি রাশিয়াকে লাভবান করতে পারে এবং যুদ্ধের কৌশলগত ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে। ইউক্রেনীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তারা পশ্চিমা সহায়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হারাতে পারেন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস, বাইডেন প্রশাসনের মতো, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন এবং সামরিক, কূটনৈতিক এবং মানবিক সহায়তা জোরদার করতে পারেন।

হ্যারিস ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার পক্ষে। তার নেতৃত্বে ইউক্রেনকে ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও উন্নত সামরিক প্রযুক্তি এবং অস্ত্র সরবরাহ বাড়তে পারে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে?।
লেখাটি শেষ করার আগে মার্কিন নির্বাচন কিভাবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের ওপর তার নীতির মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য ও অভিবাসন নীতি সাধারণত কঠোর হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষ করে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ তিনি আমদানি শুল্ক বাড়ানোর দিকে ঝুঁকতে পারেন, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকে হুমকির মুখে ফেলবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এছাড়াও ট্রাম্পের জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে অনীহা এবং পরিবেশগত উদ্যোগে কম অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য আরও উদ্বেগজনক। কারণ, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম দেশ। তার প্রশাসন এই ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব না দিলে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও জোরালো হতে পারে।  

অন্যদিকে, যদি কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে উন্নত হতে পারে। হ্যারিস প্রশাসন মানবাধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসন ইস্যুতে নমনীয় ও কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য হ্যারিস আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল বাড়াতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।

সেই সঙ্গে, হ্যারিস ন্যায্য বাণিজ্যের নীতিতে জোর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতে পারেন, যা শ্রমিক অধিকার এবং পরিবেশগত সুরক্ষায় মনোযোগ দেবেন। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ইসলামী শক্তির উত্থান পরিস্থিতিতে হ্যারিস প্রশাসন মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো সমর্থন দিতে পারে। ইসলামী শক্তির উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই হ্যারিস প্রশাসন এই শক্তির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থি দল এবং সুশীল সমাজকে সমর্থন করে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উদ্যোগ নিতে পারে।

১৩ অক্টোবর ২০২৪

[email protected]

×