ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

বিশ্বজোড়া মোহনীয় ফাঁদ

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্বজোড়া মোহনীয় ফাঁদ

বিশ্বজোড়া মোহনীয় ফাঁদ

ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা পুঁজিবাদকে ইতিহাসের একমাত্র সত্য বলে গলা চড়িয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ নামের সেই বই। কিন্ত তত্ত্ব রয়েছে তত্ত্বের জায়গায়, বাস্তবতা বলছে-পুঁজিবাদী অর্থনীতি মেরুদ-ে ভয়ানক সংক্রমণ নিয়ে মহাসংকটে। বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রক মার্কিন করপোরেট পুঁজি নিজের চক্রব্যুহে আটকে হাঁসফাঁস করছে।

সরকারি খাত ধ্বংস করে বেসরকারি খাত শক্তিশালী করার মন্ত্র নিয়ে যে নয়া উদারবাদী বাজার অর্থনীতি দুর্বিনীত ঝা-া উড়িয়েছিল তার সঙ্গে স্ববিরোধিতা করে মার্কিন সরকারকে নিজ দেশের দেউলিয়া হওয়া ব্যক্তি খাতের ব্যাংক-বীমা কোম্পানিগুলো কিনতে হচ্ছে। এসবের প্রত্যক্ষ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। এ গল্প রাঘববোয়ালের দেশের হলেও বাংলাদেশের মতো প্রান্তস্থ পুঁজির চুনোপুঁটি দেশও এর সরাসরি প্রভাবে আক্রান্ত।

এশিয়া আফ্রিকার কোটি কোটি গরিবের উপার্জন কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে। রাষ্ট্রের সেদিকে মনোযোগ কম। বাজার অর্থনীতির শর্ত মেনে রাষ্ট্র বরং অনেক বেশি মনোযোগী সম্পদশালীদের স্বার্থ রক্ষায়। এটা ক্ষমতধর রাষ্ট্রের জন্য যেমন সত্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্যও অসত্য নয়। পুঁজিবাদী ক্ষমতা কাঠামোই এ পদ্ধতি সযতেœ লালন করে। এমন সূক্ষ্ম কৌশলে প্রচার-প্রচারণা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- দিয়ে এগুলো করা হয় যে, সাধারণভাবে একে স্বাভাবিকই মনে হয়। কোথাও কোনো প্রতিবাদের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক অবসানের পর ‘উন্নয়ন অর্থনীতিতে’ বিগ ব্যাং অ্যাপ্রোচ (ইরম ইধহম অঢ়ঢ়ৎড়পয) নামের এক পলিসি প্যাকেজ পাগলা ঘোড়ার মতো ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ছুটে বেড়িয়েছে। ওই বিগ ব্যাং ছিল আসলে নিউ লিবারেলিজম বা নয়া উদারবাদী অর্থনীতির নখদন্ত বের করা দুর্ধর্ষ রূপ। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন ট্রানজিশন ইকোনমি’।

এসব দেশের সুবিধাভোগী শিক্ষিত দালালরা এতে ভাগ্যোন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন এবং খুব দ্রুত নিজেদের এর সঙ্গে ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেন। এ কাজ সহজ হয়েছিল আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ নামের দুই মোড়ল প্রতিষ্ঠানের সরাসরি হস্তক্ষেপে। এরাই তথাকথিত ওই পলিসি প্যাকেজের প্রেসক্রাইবার। অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট তৈরিই ছিল।

চিলিতে জেনারেল পিনোশে, ইন্দোনেশিয়ায় জেনারেল সুহার্তো, ফিলিপিন্সে জেনারেল মার্কোস আর বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ। এই একগুচ্ছ জেনারেল নিজ দেশে নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতির বল্গা আগেই খুলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে উনিশ শ’ বিরাশি থেকে নব্বই সময়কালে মহান জেনারেল সুনিপুণ দক্ষতায় এ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা অনেকের মনে আছে।
সত্যি বলতে নয়া উদারনীতিবাদ এদেশে এরশাদ আমলের বহু আগেই ঢুকে পড়লেও এরশাদের আমলে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের নামে ব্যাপক বিরাষ্ট্রীয়করণ, বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্য উদারীকরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নয়া উদারবাদী রাস্তায় সরাসরি চলার শুরু। কাঠামোগত সংস্কারের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে বাণিজ্য উদারীকরণ।

তৃতীয় বিশ্বের ছিয়াত্তরটি দেশে এ সংস্কার কর্মসূচি চালানো হয়েছিল। এটা করতে গিয়ে আমদানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। শুল্ক হার সংস্কার করে পণ্যের আমদানি সহজ করা হয় এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বেলায় রপ্তানি বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আশির দশকে সেই যে পথ চলা শুরু হয়েছিল কোনো বাঁকেই তা আর থামেনি। বরং তা আরও ব্যাপক বিস্তৃতি পেয়েছে। দু’হাজার সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে যে হারে বাণিজ্য উদারীকরণ হয়েছে তা দক্ষিণ এশিয়ার গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি। 
নয়া উদারবাদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, জনকল্যাণমুখী কাজে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানো। জনগণের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি না দেয়া। লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়া। রেলপথ, মহাসড়ক, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ এবং পানীয় জল সরবরাহ সংস্থা পর্যন্ত বেসরকারি খাতে দেওয়া। এসব করা হয় একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে।
রাজতন্ত্রকে পরাজিত করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক চরিত্র প্রগতিশীল থাকলেও শীঘ্রই এর আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। এ ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘সাম্য’ বুর্জোয়া শ্রেণির গণতন্ত্র ও সাম্য এর অধিকারগুলো ধনিক শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত। পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে একচেটিয়া পুুঁজিবাদে পরিণত হয় বিশ শতকের শুরুর দিকে। পুঁজিবাদী কেন্দ্রের শক্তিশালী করপোরেশনগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বিশ্বের সামগ্রিক উৎপাদনের মূল অংশ।

তৃতীয় বিশ্বের বাজার উন্মোচনেরও প্রয়োজন হয় তার। একচেটিয়া পুঁজি তাই মুনাফার জন্য তৃতীয় বিশ্বসহ বিশ্বের সব বাজার উন্মুক্ত করে। বাণিজ্য বাধা তুলে দেয়। তার  হাত এতই শক্তিশালী হয় যে, বাজারের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়। রাষ্ট্র আর বাজার পরস্পরের পরিপূরক নয়, রাষ্ট্রকে ডমিনেট করে বাজার। নয়া উদারবাদী নীতিতে বাজারই হচ্ছে মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা।

পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জন বাধা পায় এমন কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বাজারের ওপর রাষ্ট্র আরোপ করতে পারবে না। তবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যদি মুনাফার প্রবাহে বাধা তৈরি না করে তা হলে তা করা যেতে পারে। কিন্তু একচেটিয়া পুঁজির শাসনে যে রাষ্ট্র নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছে তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ যে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোয় পরিণত হয় তা বাংলাদেশের মতো দু’চারটা দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত খাতগুলো বাজারের হাতে চলে গেলে কী দশা হয় তার উদাহরণ দিতে গিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রতন খাশ নবীস এক বক্তৃতায় ভারত এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত প্রসঙ্গে বলেছিলেন, শিক্ষা এখানে শুধু পণ্যে পরিণত হয়নিÑ ধ্বংসের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছে।

বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগে কোনো লাভ হবে না যদি শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে এই অত্যন্ত জরুরি দুই খাতে রাষ্ট্রকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের কথাটা তিনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেন।
অর্থনৈতিক আগ্রাসনের প্রয়োজনেই নয়া উদারবাদ দেশে দেশে সুবিধাভোগী গবেষক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর দল গড়ে তোলে। সেই সঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠানও। যার মধ্য দিয়ে একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অভিন্ন ক্ষোভগুলো ভেঙে দেওয়া হয়।

শোষিত জনগোষ্ঠী শ্রেণি হিসেবে দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না। সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয় খ-িতভাবে। যেমন- নারী ইস্যু, জাতিসত্তা ইস্যু ইত্যাদি মৌলবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদিকে বিচ্ছিন্ন ইস্যুতে ভাগ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মেরুদ- ভেঙে দেয়। 
নানা আঙ্গিকে উন্নত অনুন্নত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া নয়া উদারবাদকে প্রথম সূত্রবদ্ধ করেন জন উইলিয়ামসন। তিনি একে দশটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় চিহ্নিত করেন। যা ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ (ধিংযরহমঃড়হ ঈড়হংবহংঁং) নামে পরিচিত। সবশেষ তথ্য হচ্ছে নয়া উদারনীতিবাদ এখন ওয়াশিংটন কনসেনসাসেই দ্বিমতে পড়েছে। এমনকি এর প্রণয়নকারী জন উইলিয়ামসন নিজেও খানিক সংশয়ে আছেন।

×