ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়

গত জুলাই মাস ছিল গণঅভ্যুত্থানের এক সংগ্রামী যাত্রাপথ

নতুন অর্থবছরের শুরুতেই গত জুলাই মাস ছিল গণঅভ্যুত্থানের এক সংগ্রামী যাত্রাপথ। পুরনো শাসন ব্যবস্থার হরেক অপসংস্কারে সারাদেশ যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে, সঙ্গত কারণেই গণজাগরণও অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। ক্ষমতা কেন্দ্রিকীরণের দুর্বিষহ পালাক্রমে টানা ১৫ বছর ছিল এক অনাকাক্সিক্ষত দুঃশাসন। ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলি যে অবধারিত সত্য উন্মোচন করেন, সেটা একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকেও যে কতখানি যথার্থ তাও অনিবার্যতা। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেনÑ ‘সকল ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে, চরম ক্ষমতা চরমভাবেই বিকৃত করে।’

গত ১৫ বছরের লাগাতার অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় তেমন অসহনীয় দুরবস্থায় সমাজ সংস্কারের যে অধোগতি, তার পরিণতিও ছিল স্বাভাবিক। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও এক অবধারিত সত্য। লাগাতার শাসনকাল কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ছিল না। তাই গণমানুষের অধিকার আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতেও বারবার পিছু হটেছে। প্রয়োজন ছিল এক গণমুখী বিপ্লব আর অভ্যুত্থানে স্বেচ্ছাচারী সরকার পতনের নতুন পালাক্রম। 
সবচেয়ে আঘাত হানা হয় স্বচ্ছ এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মূল কাঠামোতে। নির্বাচনের নামে ২০১৪ সাল থেকে যে প্রহসনের নতুন কূটকৌশল জনগণের সামনে হাজির করা হয়, তাও অভ্যন্তরীণ কাঠামোর শিকড়কে নড়বড়ে করে দেয়। জমকালো অবকাঠামোর উন্নয়ন কৌশলে ভেতরের যে দুর্বলতা, তাও লাগাতার অপশাসনের আর এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। যার স্ফুরণে সারা বাংলাদেশ বিদ্রোহের দাবানলে শিখর থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

বৈপ্লবিক আন্দোলনের চরম পরিণতিতে পুরনো শাসন অপসৃত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভেতরের অনাকাক্সিক্ষত আবর্জনায় পিষ্ট পুরো কাঠামোর যে বিপর্যয়, তা সামলানো অত সহজ নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা সময় সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু অধোগতির কোপানল কিভাবে যে দ্রুত বিস্তারিত হয়, সেটাও যেন অবধারিত দুঃসময়। 
সঙ্গত কারণেই বর্তমান বাংলাদেশ পার করছে এক ক্রান্তিকালীন পর্ব। যেখানে সর্বক্ষেত্রে সংস্কার আর নতুন কিছু যুক্ত করা পরিস্থিতির ন্যায্যতা। তাই বর্তমান সরকারের সামনে অপেক্ষা করছে নানা অবধারিত চ্যালেঞ্জ। যেখান থেকে সময়ের চাহিদায় মোড় ঘুরিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় হাজির করা হচ্ছে। নজর দিতে হচ্ছে সংস্কার কর্মযোগের মূল ব্যবস্থাপনায়। তার ওপর আছে উন্নয়ন মহাযজ্ঞের অর্থ বিনিয়োগে বিভিন্ন কারসাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি আর টাকা আত্মসাতের বিবিধ অশুভ কর্মকা-। যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজর নির্বাচন থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নানা সংস্কার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, যা নিতান্ত সময় সাপেক্ষ বিষয়।
একদিকে সমাজ ব্যবস্থায় নতুন কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রণয়ন, অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির লাগাতার দুর্ভোগ। আশ্বিনে লাগাতার বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যায় ভেসে যাওয়াও নিত্য এক দুর্ভোগের বিষয়। তার ওপর মানুষের প্রতিদিনের চাহিদায় খাদ্যপণ্যের ওপর অনাবশ্যক দুর্ভোগ। ভোগ্যপণ্য মাঝেমধ্যে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে যে মাত্রায় সিন্ডিকেট মোকাবিলা করে, তাও বলা চলে নিত্য দুর্ভোগ। দাম বাড়া কিংবা কমাও বাজার পরিস্থিতির অনাবশ্যক অস্থিরতা। এক সময় পেঁয়াজের মূল্যে যে দুর্ভোগ দৃশ্যমান হয়েছে, এখন তা নিতান্ত সহনীয় বলা যায়।

অর্থাৎ, অকারণে অপ্রয়োজনে বাড়া কিংবা কমার কোনো শেষ নেই। যা বর্তমানে ভর করেছে কাঁচামরিচের ওপর। গণমাধ্যমের খবর, দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। কিন্তু কাঁচামরিচের দামে ফারাক চোখ কপালে ওঠার মতো। কৃষক ১৩০ টাকায় পাইকারি হিসেবে কাঁচামরিচ বিক্রি করেন। কিন্তু তা কয়েক হাত বদলে গ্রাহকের হাতে যাচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে আমদানি কম। তা ছাড়া বন্যার পানিতে ব্যাহত হয়েছে মরিচ উৎপাদনও। প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ওপর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কুনজর, লভ্যাংশ অর্জন নতুন কিছু নয়।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক লাগাতার দুর্ভোগের অবিচ্ছিন্ন তাপপ্রবাহ। বলতে শোনা যায়, খাদ্যপণ্যের মূল্যে আগুন জ্বলছে। তা সহজে নেভেও না। শুধু কি তা-ই? এক সময় তা নিয়মে প্রচলিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে নতুন সময়ে নিত্যপণ্যের যে বাড়-বাড়ন্ত, সেটা যেন অবধারিত এক পালাক্রম। সেখানেই নতুন সরকারের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ হাজির হচ্ছে জনসমক্ষে। সরকার সাধ্যমতো পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। পরিবর্তনশীল সমাজের কোনো কিছু থেমেও থাকে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় চলমান অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেমন উপস্থিত সরকারের দায়-দায়িত্ব, একইভাবে সার্বিক জনগণেরও। 
দেশ এই মুহূর্তে তেমন ক্রান্তিকাল পার করছে। হরেক দুর্নীতিতে বিদায় নেওয়া সরকারের যে অর্থ লোপাট কিংবা পাচার, তার দামও গুনতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। আবার মাথাচাড়া দেওয়া হরেক দুর্বিপাকও রেহাই দিচ্ছে না। যেমনÑ লাগাতার বৃষ্টির অবধারিত দুর্যোগ, নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে চলে যাওয়া। সঙ্গে বসতবাড়ি ভাসিয়ে নেওয়াও অবিচ্ছিন্নতার আকাল। বানভাসি মানুষদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়া পরিস্থিতির এক অসহনীয় দুর্বিপাক। বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি কমে এলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়, তাও এক অনাকাক্সিক্ষত দুঃসময়।

ধীরগতিতে পানি নেমে যাচ্ছে উপদ্রুত এলাকা থেকে। কিন্তু কত সংকট যে তাড়া করছে, তাও সামলানো দায়। খাদ্যপণ্যের সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাবে এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে বন্যায় আক্রান্ত মানুষ। সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি অতি সাধারণ খেটে খাওয়া ক্ষেতমজুররা। যারা জমিতে চাষাবাদ করে। সেই ফলনে সারাবছর পরিবারের আহারের সংস্থান হয়। সেখানেই আজ বন্যা আর নদ-নদীর পানিতে আবাদি জমি তলিয়ে যাওয়া সত্যিই এক দুর্বিষহ অবস্থা। বানভাসি দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রীও জরুরি। সেখানেও সময় এবং যথার্থ ভাবে না পৌঁছানো এক দুর্যোগ।

অনেক সময় এমন সব অনাসৃষ্টি উঠেও আসে। প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা ঠিক সময়ে যথাস্থানে যেতে না পারাও দুর্ভোগের চরম আকাল। তবে বর্তমান অন্তর্বর্র্তী সরকার সাধ্যমতো দুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতে নিয়তই কাজ করে যাচ্ছে। বন্যায় মাথাচাড়া দেয় আরও এক প্রাসঙ্গিক দুর্ভোগ। পানিবাহিত রোগের চরম দুঃসময়। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া নিয়ে প্লাবিত এলাকাসমূহ নাকাল। শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের অবস্থা  সবচেয়ে বেশি নাজুক। কারণ, যে কোনো বিপন্ন সময়ে তারাই পড়ে মহাবিপাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সব মিলিয়ে বানভাসি দুর্গত মানুষদের নিতান্ত দুঃসময় বর্ণনারও অতীত।
সবটাই ছাপিয়ে সারা বাংলাদেশ এখন নতুন করে তৈরি হচ্ছে নতুন সংস্কার কর্মসূচি আমলে নিয়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শ আর নীতি-নির্ধারণ কর্মযোগকে সামনে এনে রূপরেখা দিচ্ছে। যে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান পরপর দুই বারের বেশি শাসক নির্বাচিত হতে পারবেন না। একটি রাজনৈতিক দল তার সংস্কার রূপরেখায় তা উল্লেখও করে। নির্বাচনের জন্য তৈরি বিভিন্ন দলও তাদের সংস্কার কর্মসূচির বিষয় উল্লেখ করেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের আগে সংস্কার না পরে তাও বিবেচনার দাবি উঠেছে। সময়ই নির্ধারণ করবে পরবর্তী নির্বাচন কোন্ গতিতে তার যাত্রাপথ তৈরি করবে। এখনো ফেলে আসা জঞ্জাল পরিষ্কার করতে কত সময় যে ব্যয় হবে, তাও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনরা ভাবছেন।
বর্তমান স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাও তার যথার্থ কর্মবিধিতে এগিয়ে যাওয়ার খবর স্বস্তিদায়ক। ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়, ছেলে ধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেণুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু  কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি  যে রেণু ছেলে ধরা। সঙ্গত কারণে হত্যাকারীদের একজনকে মৃত্যুদ- আর ৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন মহামান্য বিচারিক আদালত। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় একটি স্কুলে সন্তান ভর্তির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে যান রেণু বেগম।

তাকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করার মর্মান্তিক দৃশ্য লজ্জাকর ও কষ্টদায়ক। এভাবে কত মানুষ অন্যায়, অবিচারের শিকার হয়েছে। এটি কোনো সভ্য দেশের নজির হতে পারে না। সন্দেহের বশে বিচারবহির্ভূত হত্যারও কোনো অধিকার থাকে না কারোরই। সেটাই ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। তাই মূল শিকড়ের আবর্জনা, অপকৌশল, অপরাজনীতি থেকে নতুন বাংলাদেশকে বের করে আনতেই হবে। 
এটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। নতুন দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যাত্রাপথ স্বস্তিদায়ক ও নির্বিঘœ করতে সরকার বিভিন্নভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। আন্দোলনের নানামাত্রিক প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় বিভিন্ন থানার ওপরও আক্রমণ চালানো হয়। যানবাহন পোড়ানো থেকে আরম্ভ করে থানায় বিক্ষিপ্ত হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনা। তাৎক্ষণিকভাবে  বাধাগ্রস্ত হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কমে যায় পুলিশি টহল। আন্দোলনপরবর্তী সময়ে দৃশ্যমান হয় বিভিন্ন থানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের অনুপস্থিতি। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ যানবাহনের চালকরা নিজেরাই সড়ক পরিবহন আইন মেনে তাদের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করাও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির নির্ণায়ক।

শিক্ষার্থীরাও এক্ষেত্রে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে, যা প্রশংসনীয়। অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সড়ক ব্যবস্থাপনায় পুলিশি কার্যক্রম এক অবধারিত কর্মযজ্ঞ। সেখানে সামান্যতম গাফিলতি বড় দুর্ঘটনাকে উস্কে দিতে সময়ক্ষেপণ করে না। তেমন দুঃসময় পার করেও বড় কোনো দুর্ঘটনাকে আমলে নিতে হয়নি। সেটা যেন এক স্বস্তিকর প্রতিবেশ। সর্বত্র তোলা হচ্ছে সংস্কারের। অবশ্যই সর্বাগ্রে হতে হবে নির্বাচনী সংস্কার। যার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্রহণে স্বাধীন ও সুষ্ঠু ভোট জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দেবে।

শুধু তা-ই নয়, আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই অমর বাণী জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যই হবে দেশের গণতান্ত্রিক সার্বিক রাষ্ট্র কাঠামো, যেখানে সব মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, ইচ্ছা, অনিচ্ছার প্রতিফলন থাকবে তার জীবনাচরণ থেকে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সর্বক্ষেত্রে। 
লেখক : সাংবাদিক 

×