ডায়াবেটিস একটি হরমনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা
ডায়াবেটিস একটি হরমনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা। আমাদের শরীরে অনেক রকম হরমন রয়েছে। এসব হরমন সঠিক পরিমাণে শরীরে থাকলে শরীর সুস্থ থাকে। কিন্তু কোনো হরমন কম বা বেশি হয়ে গেলে তখন শরীর অসুস্থ হয়। ইনসুলিন তেমনি একটি হরমন যা শরীরের প্যানক্রিয়াস গ্রন্থি থেকে বের হয়। এই ইনসুলিন গ্লুকোজ বা চিনিকে রক্ত থেকে কোষে পৌঁছে দেয়। কারণ, কোষের ফুয়েল বা জ্বালানি হলো চিনি। যা দিয়ে কোষ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করার শক্তি পায়।
যখন কোনো কারণে প্যানক্রিয়াস প্রয়োজনীয় পরিমাণে ইনসুলিন নিঃসরণ করতে পারে না, বা একদমই ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না, তখন রক্ত থেকে গ্লুকোজ সঠিকভাবে আর কোষে পৌঁছাতে পারে না। ফলে, কোষ শক্তি পায় না। আর ওদিকে তখন রক্তে গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা বেড়ে যায়।
আবার দেখা যায় যে, প্যানক্রিয়াস থেকে সঠিক মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোষের ওপরে থাকা ইনসুলিন রিসিপটর ইনসুলিন গ্রহণ করছে না। ফলে, গ্লুকোজ কোষ বা সেলে ঢুকতে পারছে না। এই অবস্থাটাকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। ইনসুলিন প্রয়োজনের চেয়ে কম বের হওয়া বা একদমই না বের হওয়া বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে রক্তে গ্লুকোজ বা চিনি ভেসে বেড়াতে থাকলে শরীরের কোষগুলো চিনির অভাবে শক্তি পায় না। আবার রক্তে অস্বাভাবিক মাত্রায় চিনি ভেসে বেড়ানোর কারণে জটিল সব স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাটাকেই ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস থেকে শরীরে যেসব
জটিলতা তৈরি হতে পারে
ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক জীবনযাপনের নিয়মগুলো মেনে চলা শুরু করতে হবে। মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর যদি ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা না হয়, তবে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে তৈরি হওয়া সমস্যা শরীরে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যা থেকে চিরস্থায়ী ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। রক্তে উচ্চমাত্রার চিনি অঙ্গহানি, স্নায়ুহানি এবং রক্তনালির ক্ষতি করে।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে তৈরি হওয়া জটিল স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো হলো-
* পায়ে ব্যথা অনুভব করা বা পা অবশ হয়ে যাওয়া।
* ত্বকের সংক্রমণ। রক্তে উচ্চ মাত্রার চিনির উপস্থিতি শরীরে রক্ত চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করে। যার ফলে ত্বকের ওপর কোনো ক্ষত হলে তা সহজে শুকাতে চায় না।
* অস্বাভাবিক ক্লান্তি।
* অন্ধত্ব। রক্তে উচ্চমাত্রার চিনি চোখের রক্তনালি এবং স্নায়ুর ক্ষতি করে।
* কিডনির ক্ষতি করে। অনেক ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়।
* উচ্চ রক্তচাপ।
* হৃদরোগ।
* স্ট্রোক (পক্ষাঘাত/প্যারালাইসিস)।
* যৌনাঙ্গে ইস্ট সংক্রমণ এবং স্বাভাবিক যৌন চাহিদা কমে যাওয়া, যৌন মিলনের সময় ব্যথা পাওয়া।
* মাড়ির সংক্রমণ, দাঁত পড়ে যাওয়া।
* আলসার।
* ডায়াবেটিক ফুট। ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুর ক্ষতি হয়ে পায়ে অনুভূতিহীন অবস্থা তৈরি হয়। যার ফলে, পায়ে আঘাত লাগলে তা বুঝতে পারা যায় না। পায়ের অবশ ভাবের কারণে পায়ে আঘাত লাগলে বুঝতে না পারা থেকে যে ক্ষত তৈরি হয়, তা না শুকালে অনেক সময় ফুট গ্যাংরিন (পায়ে পচন ধরে) হয়ে যায়। এই অবস্থায় ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের গ্যাংরিন হওয়া অংশটুকু কেটে ফেলতে হয়।
ডায়াবেটিসে জরুরি অবস্থা
হাইপোগ্লাইসেমিয়া : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে যখন চিনির মাত্রা অস্বাভাবিক হারে কমে যায় তখন সে অবস্থাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার কারণগুলো হলো-
* অতিরিক্ত ইনসুলিন নিলে।
* ইনসুলিন নিয়ে এবং ডায়াবেটিসের ওষুধ একসঙ্গে খেলে।
* পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার না খেলে।
* একনাগাড়ে অতিরিক্ত ব্যয়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করলে।
* একবার খাওয়ার সময় থেকে দ্বিতীয়বার খাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বিরতি দিলে।
* এলকোহল পান করলেও হাইপোগ্লাইসেমিয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে।
প্রতি আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর অল্প পরিমাণে স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যায়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসা
* রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে দ্রুত চিনি, মধু, ফলের রস, চকোলেট, বা এক গ্লাস পানির মধ্যে কয়েক চামচ চিনি মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। এর পরপরই রোগীকে খাবার খাওয়াতে হবে। এরপর রক্তে চিনির মাত্রা চেক করতে হবে। চিনিজাতীয় খাবার খাওয়ানোর পরও যদি রোগী বিভ্রান্ত থাকে বা ১৫ মিনিটের মধ্যে ভালো অনুভব করতে শুরু না করে, তবে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
* রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে রোগীর জিহ্বার নিচে এক চিমটি চিনি বা মধু রাখতে হবে এবং কিছু সময় পর পর রোগীকে অল্প পরিমাণে চিনি বা মধু দিয়ে যেতে হবে। কারণ, শরীরে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। রোগীর জ্ঞান ফিরে এলে চিনির শরবত, ফলের রস, মধু বা চিনি বেশি করে খাওয়াতে হবে। বিপদ চিহ্নগুলো যেন আর দেখা না যায়, তা নিশ্চিত হতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার জন্য রোগীর কাছে কাউকে থাকতে হবে।
হাইপারগ্লাইসেমিয়া : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অনেক বেশি মাত্রার চিনির উপস্থিতিকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে। রক্তে উচ্চমাত্রার চিনির উপস্থিতির চিকিৎসা না করলে তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং তা থেকে মানুষ কোমায় চলে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
হাইপারগ্লাইসেমিয়ার চিকিৎসা
প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে প্রথমেই রোগীর রক্তে চিনির মাত্রা পরিমাপ করে নিতে হবে। তারপর রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে একটু একটু করে পানি পান করাতে হবে এবং দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাছের কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিকার, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে ন্যাচারোপ্যাথি এবং ইয়োগা ব্যবস্থাপনা
ন্যাচারোপ্যাথি এবং ইয়োগা ব্যবস্থাপনা হলো সঠিক সুস্থ জীবন যাপন করার একটি গাইডলাইন। এই গাইডলাইন মেনে চললে ডায়াবেটিস হবে না। আর যাদের হয়ে গেছে, তারাও খুব সহজে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং জীবনকে অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতো আনন্দে উপভোগ করতে পারবেন।
সুস্থ থাকার কিছু গাইডলাইন
নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েট : ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবারের চেয়ে প্রোটিন এবং শাকসবজি জাতীয় খাবার বেশি খেলে ভালো। এতে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ আলাদা। সব রকম খাবার আইটেমের প্রতি সবার শরীরের ভিতরের মেকানিজম এক রকমভাবে সাড়া দেয় না। তাই প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীর অবশ্যই চিকিৎসক এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তালিকা করে নিয়ে সে অনুযায়ী খাবার অভ্যাস মেনে চলা জরুরি।
আকুপ্রেসার থেরাপি : আকুপ্রেসার একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। যেখানে হাতের তালু এবং পায়ের তালুর নির্দিষ্ট বিন্দুগুলোতে থেরাপি করে অসুখ বিসুখ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়। হাতের তালু এবং পায়ের তালুর প্যানক্রিয়াস, এড্রিনাল, থাইরয়েড, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদান্ত্রের বিন্দুগুলোতে প্রতিদিন খালিপেটে আকুপ্রেসার থেরাপি করলে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ইয়োগা থেরাপি
আসন
* মু-ুকাসন।
* অর্ধ মৎসেন্দ্রাসন।
* পবন মুক্তাসন।
* জঠরা পরিবর্তন আসন।
* উত্থানপাদাসন।
* নৌকাসন।
ইয়োগার এসব আসন প্যানক্রিয়াসকে শক্তিশালী এবং কার্যকর রাখতে সাহায্য করে।
প্রাণায়াম
* নাড়িশোধনা।
* ভস্ত্রিকা।
* ভ্রামরি।
মেডিটেশন
* মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন।
* রিলাক্সেশন টেকনিক।
প্রাণায়াম এবং মেডিটেশন করলে ডায়াবেটিস রোগী শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ এবং প্রশান্ত থাকতে পারে।
হারবাল
* করলার রস।
* মেথি।
* আমলকী।
* কাঁচা হলুদ গুঁড়া।
* সজনে পাতার গুঁড়া।
* জাম এবং জামের বিচির গুঁড়া।
* কালো জিরা।
* দারুচিনি।
* ভিনেগার।
এই হারবালগুলোর প্রতিটির রয়েছে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখার গুণ। কোনটা, কখন, কোন্্ ঋতুতে, কি পরিমাণে খেতে হবে তা রোগীর সঙ্গে কথা বলে তাকে দেখে ঠিক করে দিতে হয়।
উপরোল্লিখিত ন্যাচারোপ্যাথি এবং ইয়োগা থেরাপির প্রতিটি পদ্ধতি কোনো প্রকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়া ডায়াবেটিস প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং নিরাময় করে থাকে। সুতরাং, ডায়াবেটিস মানেই হেরে যাওয়া নয়। ডায়াবেটিসকেও হারিয়ে দেওয়া যায় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মে। আসুন, ন্যাচারোপ্যাথি-ইয়োগা ব্যবস্থাপনার নিয়মগুলো অনুসরণ করি, ডায়াবেটিস মুক্ত জীবন গড়ি।
লেখক : কনসালট্যান্ট অ্যান্ড ট্রেইনার অব ন্যাচারোপ্যাথি অ্যান্ড ইয়োগা