জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে বলা হয় বিশ্বের আইন পরিষদ
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে বলা হয় বিশ্বের আইন পরিষদ। বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এখানে প্রায় সব বৈশ্বিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক মন্দা ও যুদ্ধাবস্থার মতো জটিল মুহূর্তে হয়ে গেল জাতিংসঘের সাধারণ অধিবেশন। দুই বছরের অধিক সময় ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন, নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ যুদ্ধের শঙ্কার বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সমবেত হয়েছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে। জাতিসংঘের প্রধান নীতিনির্ধারণীর অংশ এই পরিষদ। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সারাবিশ্বের জাতিসংঘের সদস্য সব দেশের নেতা বৈঠকে বসেন এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মাঝে ভোটাভুটিও হয়। যেমন- এবারের অধিবেশনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ফিলিস্তিন।
জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য না হয়েও এবারে অধিবেশনে অংশ নিয়েছে ফিলিস্তিন মিশন। এ বছর মে মাসে সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সদস্য করতে পক্ষে ভোট দিয়েছিল ১৪৩টি দেশ। এবারের অধিবেশনে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের যুদ্ধ এবং দখলদারিত্ব বন্ধ নিয়েও ভোট হয়েছে। সেখানে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১২৪টি দেশ পক্ষে, ১৪টি বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ৪৩টি দেশ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মধ্য দিয়ে আগামী এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বেআইনি দখলদারিত্ব বন্ধে প্রস্তাব পাস হয়েছে।
এবারের অধিবেশনে সংঘাত নিরসন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করাসহ ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সংস্থাটির একমাত্র শাখা, যেখানে ১৯৩টি সদস্য দেশের সবাই প্রতিনিধিত্ব করার এবং সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ পায়। সভার বাইরে নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক সাধারণত বেশি গুরুত্ব বহন করে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আশা করা হয়েছিল এই বিশ্ব সংস্থাটি পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, অনুন্নয়ন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঠেকাবে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যে দেশগুলো জার্মানি ও তার মিত্রদের পরাস্ত করে, তারাই এই সংস্থা গঠনের আসল চালিকা শক্তি। জাতিসংঘকে নিয়ে আশা ও উৎসাহের সেটাই আসল কারণ। কিন্তু খুব বেশি দিন লাগল না দেশগুলোর বন্ধুত্বে চিড় ধরতে। শুরু হয়ে গেল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। যারা যুদ্ধ ঠেকাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, দেখা গেল তারাই যুদ্ধ বাধাতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। পৃথিবীকে এক করার বদলে তাকে বিভক্ত করে যার যার প্রভাব বলয়ে আনাই তাদের আসল লক্ষ্য। এরপর ৭৮টি বছর কেটে গেছে।
অবস্থা বদলায়নি, বরং বহুগুণে অবনতি ঘটেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যখন সবচেয়ে বেশি দরকারি হয়ে ওঠে, সে সময়ই তার দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে জাতিসংঘের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর বিশ্বনেতারা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ভবিষ্যতের সম্মেলনে জড়ো হয়েছেন। এই সম্মেলনের এজেন্ডা তার শিরোনামের মতোই উচ্চাকাক্সক্ষাপ্রসূত। কারণ, এখানে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো একটি বিষয়ে একমত হয়েছে। সেটি হলো আজকের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার জন্য ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে হালনাগাদ করতে হবে। এর মাধ্যমে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে। সুদান, মধ্য আফ্রিকা, গাজা, ইউক্রেন এবং আরও ডজনখানেক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধ বন্ধ করতে; নিদেনপক্ষে এসব যুদ্ধকে স্তিমিত করতে জাতিসংঘ যে কতটা অক্ষম, সে বিষয়ে সদস্য দেশগুলো ভালো করেই জানে। করোনার ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পরও পরবর্তী মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বকে প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তারা স্বীকার করে।
ঋণসংকট, তীব্রতর জলবায়ু সংকট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জিন-সম্পাদনার মতো নতুন প্রযুক্তির উত্থানকে সামাল দিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা সবাই স্বীকার করেছে। কিন্তু কথা হলো, বিশ্বব্যবস্থা ঠিক করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তারা একমত হলেও কীভাবে তা করা হবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে ভবিষ্যতের চুক্তি নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সম্মেলনে দেখা গেল, রাশিয়া চূড়ান্ত নথি পাসের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বসল।
অবশ্য দেশটির আপত্তি শেষ পর্যন্ত খারিজ করা হয়। ওইদিনই আর্জেন্টিনা চুক্তিটিকে একটি সর্বগ্রাসী এজেন্ডা বলে নিন্দা জানায়। তবে বাস্তবতা হলো, নথিটিতে আগেকার সর্বসম্মত বিষয়গুলোই আছে; শুধু ভাষাগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এত লম্বা লম্বা আলাপের মধ্যেও বৈশ্বিক রাজনীতিকে এমন একটি নতুন আদল দেওয়ার চেষ্টা আছে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম। কিন্ত বাস্তবতা হলো, এই ধরনের বৈশ্বিক শাসন আজকের বিশ্বের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।
বিশেষ করে ত্রিশ বছরের নিচে যে চারশ’ কোটি যুবক ও তরুণ রয়েছে, তাদের জন্য তো নয়ই। তাদের জন্য নতুন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। বহু মহাদেশে এখন সংঘাত চলমান রয়েছে। তারপরও যুদ্ধই এখন আর একমাত্র বৈশ্বিক এজেন্ডা নয়। মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, ব্যাপক অভিবাসন এবং প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের সব বিষয়ে কার্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। চীনের উত্থান এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে এটি বৈশ্বিক এজেন্ডা গঠনের একমাত্র দেশ নয়।
বার্বাডোজ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য চাপ দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আঞ্চলিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করেছে। অবিশ্বাস্যভাবে ভবিষ্যতের চুক্তি বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বহু মেরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের মতো সবচেয়ে কঠিন সমস্যা সমাধানে ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি আসছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলো উন্নয়নশীল দেশ এবং ছোট ও মাঝারি আকারের রাষ্ট্রগুলোকে সাধারণ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করতে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। এই চুক্তি সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ব্যবহৃত ভেটো ক্ষমতার ব্যাপ্তি ও ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে আলোচনা চালানোর প্রস্তাব করেছে।
ভবিষ্যতের চুক্তি, স্থানীয় এবং আঞ্চলিক সরকার, বেসরকারি খাত, একাডেমিক ও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং আদিবাসী জনগণসহ সমগ্র সমাজে অংশীদারিত্বকে জোরদার করার অঙ্গীকার করে। সর্বোপরি, সম্মেলনটি দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলছে। বাংলাদেশের পক্ষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন সময় জাতিসংঘের এই অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন, যার মাত্র দেড় মাস আগে বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ফলে, এবারের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়েছে।
জাতিসংঘ যে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, সে কথা স্বয়ং মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস স্বীকার করেছেন। শান্তিরক্ষার বাইরে এই মুহূর্তে জাতিসংঘের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা। আর মাত্র ১০ বছরের মধ্যে যদি ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা কমিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে বিশ্ব এক অনিবার্য ভয়াবহ বিপর্যয়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ জন্য একদিকে প্রয়োজন জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন সূর্য বা বাতাসের ব্যবহার বাড়ানো।
অথচ যারা এই বিশ্বের হর্তাকর্তা, তারাই সবচেয়ে বেশি গ্যাস-তেলের কারবারি। অন্য যে কাজটি করা একই রকম জরুরি, তা হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান। এ বিষয়ে ধনী দেশগুলো লম্বা লম্বা কথা বলেই তাদের দায়িত্ব সেরেছে, অর্থপূর্ণ খুব সামান্যই করেছে। জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক ভাষণে গুতেরেস বলেছিলেন, ‘একতাবদ্ধ হওয়ার বদলে আমরা বিশ্বকে খ-বিখ- করে ফেলছি। লক্ষ্য অর্জনের বদলে আমরা একে-অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এভাবে জড়িয়ে গেছি যে, সংস্থাটি তার চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলছে।’
বিশ্বে বিভক্তি বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, লক্ষ্যপূরণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। কোনো সন্দেহ নেই, এই বিপদের কারণ বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলো নিজেরাই তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২২ সালে প্রতিবেশী ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে জাতিসংঘের অন্যতম স্থপতি রাশিয়া- অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেরাই সংস্থাটির প্রতি বুড়ো আঙুল দেখায়। জাতিসংঘ সনদের একটি প্রধান প্রতিশ্রুতিই হচ্ছে- কোনো দেশ, তা সে ছোট বা বড় যা-ই হোক, কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়, এমন কাজ করবে না। রাশিয়া ঠিক সেই কাজটি করে বসেছে।
শুধু রাশিয়া নয়, জাতিসংঘভুক্ত অধিকাংশ বৃহৎ রাষ্ট্র বেশির ভাগ দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সমস্যার মোকাবিলায় জাতিসংঘের দ্বারস্থ না হয়ে নিজের পছন্দমতো রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে। জাতিসংঘ যে এখন নখদন্তহীন একটি পোষা বিড়াল মাত্র, তার এক বড় কারণ এই সংস্থাটিকে এড়িয়ে বিশ্বের দেশগুলো যে যার মতো ছোট ছোট জোট গঠন করে নিয়েছে। অথচ সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বিশ্বের প্রয়োজন একটি কার্যকর জাতিসংঘ।
জলবায়ু সংকটের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে গাড্ডলিকায় পড়ব আমরা সবাই। একই কথা কোভিডের মতো অতিমারি নিয়ে। তার চেয়েও বড় অতিমারি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। গৃহযুদ্ধে অথবা আন্তঃসীমান্ত সামরিক সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে দুই ডজনের মতো দেশ। দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। কথা ছিল, এসব সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দেবে জাতিসংঘ। কিন্ত বাস্তবে তার ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছে বিশ্ববাসী। অন্য কথায়, গত সাত দশকে বিশ্ব বদলেছে, কিন্তু বিশ্ব সংস্থা বদলায়নি। সবাই এ কথা মানেন, জাতিসংঘকে ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক