কাঁচাবাজারের জন্য নগরবাসী পাড়া-মহল্লার ছোট বাজার
সাধারণত বাসার কাঁচাবাজারের জন্য নগরবাসী পাড়া-মহল্লার ছোট বাজার, দোকান বা ভ্যানগাড়ির ওপর নির্ভরশীল থাকে। বড়জোর আশপাশের কোনো বড় বাজার। সম্প্রতি এক বন্ধুর পরামর্শে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে কাঁচাবাজার করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। দু’একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতে পারে। দুইদিন আগে মহল্লায় রাস্তার ওপর বাজারে চারটি বড় সাইজের এক হালি লেবুর (কলম্বো লেবু) দাম হাঁকিয়েছিল ৬০ টাকা। এত টাকা দিয়ে লেবু কিনতে ইচ্ছে হয়নি।
কারওয়ানবাজারে খুচরা দোকানে আরও বড় সাইজের এক হালি লেবুর দাম চাইল ৪০ টাকা। এই দোকানিও সকালে পাইকারি বাজার থেকে নিশ্চয়ই আরও অন্তত ১০ টাকা কমে লেবু কিনে এখন খুচরা বিক্রি করছেন। পাইকারি বাজারে এক হালি লেবুর দাম ৩০ টাকার বিপরীতে মহল্লার দোকানে দাম ৬০ টাকা। আমি নিশ্চিত শুধু আমার এলাকায় নয়, গোটা শহরের সকল খুচরা বাজারে এই লেবু ৬০ টাকা বা ৫ টাকা কমবেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে কারওয়ানবাজারের খুচরা দোকানে দেশী শসা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি যা মহল্লার দোকানে ৮০/৯০ টাকা, করলা ৬০ টাকা যা মহল্লার দোকানে ৮০/৯০ টাকা, আদা ২০০ টাকা যা পাড়ার দোকানে ২৬০ টাকা ইত্যাদি।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি বাজারের তুলনায় কাঁচা শাক-সবজি মহল্লার দোকানে প্রায় দ্বিগুণ। অন্যান্য পণ্যের দামেও বিশাল পার্থক্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, রাজধানীর সকল এলাকায় পাইকারি বাজার এবং মহল্লার খুচরা বাজারের দামের পর্থক্য প্রায় একই রকম। অর্থাৎ মহানগরীর সকল খুচরা ব্যবসায়ীর মধ্যে একটি অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে যার মাধ্যমে সকল পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। একাধিক খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, প্রতিদিন ভোরে পাইকারি বাজারে কেনা-বেচার সময়ই খুচরা বাজারের দাম নির্ধারণ হয়ে যায়।মোবাইল ফোন অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে সকল খুচরা ব্যবসায়ী এই মূল্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে যান এবং প্রায় একই দামে সকল এলাকায় পণ্য বিক্রি করেন।
আগে বিষয়টি এমন ছিল না। দুই দশক আগেও রাজধানীর একেক এলাকায় পণ্যের দাম একেক ধরনের হতো। যেমন নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারে পণ্যের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। বলা হতো এই বাজারে ধনীরা কেনাকাটা করেন এবং সবচেয়ে ভালোমানের পণ্য কেনাবেচা হয়। ঠাঁটারীবাজার (পুরান ঢাকা) কিংবা মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম। এমনকি শান্তিনগর বাজারের তুলনায় খিলগাঁও বাজারেও পণ্যের দাম ছিল অপেক্ষাকৃত কম। যারা একটু কম দামে পণ্য কিনতে চাইতেন তারা দামি বাজারগুলো এড়িয়ে চলতেন। অনেকে এক মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য দূরে কোনো বাজারে যেতেন। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজধানীর সকল বাজারেই পণ্যের দাম থাকে কাছাকাছি। শুধু তাই নয়, দেশের সকল বড় শহরেও কাঁচা পণ্যের দাম কাছাকাছি থাকে। পাইকারি থেকে খুচরা বাজারের মূল্যের পার্থক্য এবং নগরীর সকল ব্যবসায়ীর মধ্যে অঘোষিত সমঝোতাকে কি বলা হবে? এটাই কি তাহলে বাজার সিন্ডিকেট, নাকি অন্য কিছু?
এতদিন সাধারণত বাজার সিন্ডিকেট বলতে বড় ব্যবসায়ীদের বোঝানো হতো। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বড় বড় আমদানিকারক কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ীরা সমঝোতা করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন। কখনো সমঝোতার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথাও শোনা গেছে। চালকলের মালিক কিংবা আড়তদারদের সমঝোতার মাধ্যমে চালের দাম বৃদ্ধির কথাও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই সমঝোতা বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্যের দাম নির্ধারণ এবং একযোগে একই দামে পণ্য বিক্রির কাজটি সহজ।
এই সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা থাকে সীমিত। যে কোনো সময় যোগাযোগের মাধ্যমে তারা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। খুচরা বাজারে সিন্ডিকেটের আকার বেশ বড়। হাজার হাজার সদস্য নিয়ে এমন সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। কাজটি কঠিন হলেও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি সহজ হয়ে গেছে। এভাবেই বাজার সিন্ডিকেটের বিস্তৃতি ঘটেছে তৃণমূল পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ানোর ঘটনাটি ঘটছে এই তৃণমূল সিন্ডিকেটে।
গত দুই দশক থেকে আরও একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে অনেক সরেজমিন রিপোর্ট, টকশোগুলোতে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। ফল হয়নি কিছুই। বিষয়টি হচ্ছে, কাঁচা পণ্যের উৎপাদন পর্যায় থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত মূল্যের বিস্তর পার্থক্য। এমনও রিপোর্ট পাওয়া গেছে, উৎপাদক কৃষক স্থানীয় বাজারে ১০/১৫ টাকায় বেগুন বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই বেগুন রাজধানীতে এসে বিক্রি হচ্ছে ৮০/৯০ টাকা। উৎপাদক এবং ভোক্তা পর্যায়ের এই বিস্তর মূল্য পার্থক্য কমানো যায়নি কিছুতেই। কাঁচা শাকসবজি ছাড়াও এই সমস্যা রয়েছে পোল্ট্রি শিল্পে। বাজারে মুরগি ও ডিমের উচ্চ মূল্য নিয়ে প্রতিদিন প্রচার মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।
তৃণমূল খামারি পর্যায়ে উৎপাদনের প্রকৃত খরচ, উৎপাদক এবং খুচরা বাজারে মূল্য পার্থক্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয় খুবই কম। এই পার্থক্যের কারণে একদিকে উৎপাদকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে দিনের পর দিন, অন্যদিকে ভোক্তাদের গুনতে হচ্ছে বেশি টাকা। পচনশীল এই পণ্যগুলোতে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফার হার কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়নি।
‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে। লাতিন শব্দ সিন্ডিকাস থেকে ফরাসি ভাষায় যুক্ত হয়েছে এই শব্দটি। এর অর্থ হচ্ছে ‘একটি সমস্যার তত্ত্বাবধায়ক’। অর্থাৎ কোনো সমস্যা সমাধানে এক সঙ্গে কাজ করা। মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী সিন্ডিকেট হলো এমন একটি দল যারা একসঙ্গে কাজ করে। এটি একটি কাউন্সিল, সংস্থা বা সমিতি যা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। তারা ব্যবসায়িক প্রচারপ্রপাগান্ডার জন্য প্রচার মাধ্যমে নানা তথ্য দিতে পারে। সিন্ডিকেটের এই সংজ্ঞার সঙ্গে আমাদের দেশের প্রচলিত কর্মকা-ের কোনো মিল নেই। আমাদের দেশে সিন্ডিকেট করছে উল্টো কাজ।
তারা কোনো কিছুই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারপ্রপাগান্ডার মাধ্যমে করছে না, তাদের সব কিছুই হয় গোপনে। সাধারণ ক্রেতার স্বার্থ তাদের কাছে গৌণ। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই তারা নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। গত পনেরো বছর আওয়ামী লীগ সরকার এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। একজন বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন, তারা সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়। অর্থাৎ সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে সরকার পর্যন্ত তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিন্ডিকেটের এত বিশাল শক্তি অর্জনের নেপথ্য কারণ কি?
দীর্ঘ সময় একটি রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র ক্ষমতার জন্য সমাজে তৈরি হয়েছে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি। এরা নানা কৌশলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। নিজেদের রাজনীতিকরণের মাধ্যমে তারা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। এদের স্পর্শ করার ক্ষমতা প্রশাসন কিংবা সরকারের কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এই গোষ্ঠীর ক্ষমতা খর্ব করা কিংবা লাগাম টেনে ধরার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ক্ষমতার জন্য জনগণের ম্যান্ডেটের প্রয়োজন না থাকায় তাদের ভাবতে হয়নি মানুষের কথা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের উৎসাহিত করতে দেখা গেছে। প্রশাসন কিংবা সরকারের মন্ত্রী ছিল তাদের হাতের পুতুল। এরাই নেতৃত্ব দিয়েছেন বাজার সিন্ডিকেটের নানা পর্যায়ে। এদের দাপটের কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে হয়েছে।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণে এইসব সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, মানুষের ভোটের পাশাপাশি ভাতের নিশ্চয়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রেখে মানুষের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য সকল পর্যায়ে বাজার সিন্ডিকেট চক্র ভাঙ্গার কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। বেশি চাপাচাপি করা হলে এরা বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এদের হাত এতটাই লম্বা যে তারা বাজারে পণ্য সংকট তৈরি করে অচলাবস্থাও তৈরি করতে সক্ষম। বাজারে অভিযান পরিচালনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়, এটি অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রহণ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত একটি নজরদারি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
এই কাজে শুধু প্রশাসন ব্যবহার করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। প্রতিদিনের সঞ্চালিত কাঁচা অর্থে ভ-ুল করে দেওয়া হবে সবকিছু। দেশের নাগরিকদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে এই নেটওয়ার্কে। প্রয়োজনে গড়ে তুলতে হবে কয়েক স্তরের নেটওয়ার্ক। সকল স্তরে ক্রয় বিক্রয়ে কঠোর নজরদারি করতে পারলে উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের বিরাট পার্থক্য কমে আসবে। তখনই কেবল খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব হবে। বাজার চলে আসবে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে।
বিশে^র সকল উন্নত রাষ্ট্রে পণ্য ক্রয়বিক্রয় হয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার বেঁধে দেওয়া মূল্যে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সঠিক পর্যালোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করে পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন খরচ। সে অনুযায়ী নির্ধারণ হয় উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অন্য কোনো কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি কিংবা চাহিদার কথা বিবেচনা করে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাই মাঝে মধ্যে পণ্যমূল্য পুনর্নির্ধারণ করে থাকে। কোনো পর্যায়ের বিক্রেতাই এই দামের বাইরে যেতে পারে না। কেউ যাওয়ার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
আমাদের দেশেও এমন একটি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা রয়েছে। তারা পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয় করে বাজারে একটি বিক্রয়মূল্যের তালিকা টানিয়ে দেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে সীমিত আকারে। জনবল এবং সুযোগ-সুবিধার অভাবে সংস্থাটি খুব একটা কর্মক্ষমতা দেখাতে পারছে না। বিপণন পদ্ধতিতে সংস্কার, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটিকে শক্তিশালী ও কার্যক্ষম করা এবং সকল শ্রেণির নাগরিকের সমন্বয়ে তৃণমূল পর্যন্ত নজরদারি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারলে আমাদের দেশেও নির্ধারিত মূল্যে পণ্য কেনাবেচা সম্ভব। এমন একটি ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারে পণ্যের সঠিক মূল্য। এতে লাভবান হবে উৎপাদক এবং ভোক্তাÑউভয়ে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ