ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

শিল্প-সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গা

সুকান্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১০ অক্টোবর ২০২৪

শিল্প-সংস্কৃতিতে দেবী দুর্গা

দেবী দুর্গা

ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির গ্রহণ ও আত্তীকরণের ক্ষমতা অসামান্য। বিভিন্ন ভাষার বহু শব্দ ও সাংস্কৃতিক উপকরণ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে বারবার। উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণ থেকে রাম-সীতা, রাধাকৃষ্ণের মতো চরিত্র মিশে গেছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরতে পরতে। আরব-পারস্যের কাহিনীর ঐতিহ্যও সমাদৃত হয়েছে দোভাষী পুঁথিতে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বাংলা রামায়ণ সৃষ্টি তত্ত্বের পূর্ববর্তী রচিত সাহিত্য কর্মের ইতিহাসে দুর্গোৎসবতত্ত্ব ও প্রাসঙ্গিক প্রায়োগিক বর্ণনা উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবে। মার্ক-েয় পুরাণ, দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণসহ শাস্ত্রীয় সব গ্রন্থে সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে দেবী দুর্গার বহুমুখী উপাসনার রীতি ও পূজা পদ্ধতি। জ্ঞানশক্তি, সম্পদশক্তি সংগ্রাম কৌশল শিক্ষায় আসুরিক শক্তির বিনাস সাধনে সিদ্ধিশক্তির সম্মিলন প্রক্রিয়াও শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলোতে বিধানাকারে অবতীর্ণ বিষয় হিসেবে বিধৃত আছে। পৌরাণিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক এবং সাহিত্যিক বর্ণনার চেতনা থেকে সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা শক্তির উৎস চিহ্নিত করে অকৃত্রিম ভালোবাসা, ক্ষমা, সরলতা, পবিত্রতা ও ত্যাগের আদর্শ হিসেবে করে থাকেন দৈবশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গার পূজা-অর্চনা ও আরাধনা।
বৈদিক সাহিত্যেও দেবী দুর্গার উল্লেখ আছে। দুর্গাকে ডাকা হয় আদ্যশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা প্রভৃতি নামে। বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে দুর্গাপূজার প্রচলন-সম্পর্কিত বিবিধ কিংবদন্তি রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে, দুর্গোৎসবের প্রবর্তক স্বয়ং কৃষ্ণ। আদিবৃন্দাবন ক্ষেত্রের মহারাসম-লে প্রথম দুর্গাপূজার পর মধুকৈটভের ভয়ে দুর্গার আরাধনা করেন ব্রহ্মা।

তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেন মহাদেব, ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে সংকটাপন্ন হয়ে। দুর্বাশা মুনির দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র চতুর্থবার দুর্গাপূজা করেন। এরপর থেকে পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু দেবী দুর্গার আরাধনা করেনÑ এর উল্লেখ আছে দেবীভাগবতপুরাণে।
এদিকে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজা উঠে এসেছে বিভিন্ন রচনায়। দেবী দুর্গা সেখানে কখনো মাতৃরূপে, কখনো শক্তি রূপে, আবার কখনো বা এটিকে দেখা হয়েছে কেবল অনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়Ñ‘পুতুল পূজা করো না হিন্দু, কাঠ মাটি দিয়ে গড়া/মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, যাই আত্মহারা’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ দেবী দুর্গাকে আনন্দময়ী হিসেবে অভিহিত করে আরাধনা করেছেন মুক্তি ও ভক্তির সঙ্গে। রবীন্দ্র কাব্য, ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটকে এমনকি চিঠিপত্রে উজ্জ্বল আনন্দময় দুর্গোৎসবের অপরূপ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা, সন্দ্বীপ ও নিখিলেশ চরিত্রগুলো দেবী দুর্গার সার্বজনীন সমন্বিতা রূপবৈচিত্র্যপূর্ণ করে সাজিয়েছেন। অন্যদিকে অপূর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, অখ-তাকে মুক্তির পরিপূর্ণ তাৎপর্যে নিপুণভাবে সাহিত্যে প্রবেশ করিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেবী দুর্গাকে নজরুল দেখেছেন, ‘রক্তাম্বরধারিণী রূপে’। গান, কবিতা, উপন্যাস, ছায়াবাণী ছাড়াও প্রীতি, সৌহার্দ্য, সম্ভাষণে শাক্ত পদাবলি রচনা করে মহাকালজয়ী হয়েছেন।
দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে লেখা নজরুলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘আগমনী’। কবিতাটি ১৩২৭ সালের আষাঢ় সংখ্যায় উপাসনা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। পরে সংকলিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায়। কবিতাটি জুড়ে রয়েছে যুদ্ধের আমেজ ও দানব শক্তিকে পরাজিত করার সংকল্পÑ ‘আজ রণ-রঙিনী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ/দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!/পদতলে লুটে মহিষাসুর,/মহামাতা ওই সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে/শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!’ দুর্গার আগমন এভাবে নজরুলের হাতে এক নতুন প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে। 
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদনের কালজয়ী সৃষ্টি। এখানে তিনি দেবী দুর্গাকে কল্পনা করেছেন ‘শশাঙ্কধারিণী রূপে’। বক্ষ বিদীর্ণ করা কিছু ‘সনেট’ রামায়ণ মহাকাব্যকে দুর্গোৎসবের পরিপূর্ণ প্রয়োজন রূপে রূপায়িত করেছেন মধুসূদন। দেবী বিসর্জন ট্র্যাজেডির এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যকে সমাপ্ত করেছেন তিনিÑ ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে,/সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।’
বাংলা সাহিত্যের আরেক নবরূপকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ী দেবী দুর্গার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারেননি তিনি। পার্বতী এবং দুর্গা নামে কোমল, কঠিন ও মমতাময়ী আবেগপ্রবণ হৃদয়স্পর্শী চরিত্রায়ণ করে আরাধনায় রূপান্তরিত করেছেন সাহিত্য সৃষ্টিকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকর্মে দেবী দুর্গার মাতৃমুখী সংস্কৃতি লাবণ্যে অপূর্ব বর্ণনায় আশ্চর্যজনক অভিব্যক্তি সৃষ্টিতে দেখিয়েছেন পারদর্শিতা।

দেবী দুর্গাশক্তির সর্বজয়া উত্থানে কৌতূহল ও উৎসাহ সৃষ্টির অনুভূতি প্রভাব বৈরিতার অবসান ঘটিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার সমাজিক সাহিত্যকর্মে। অপু-দুর্গা, সতু, মালতী, হরিহর, ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্রগুলোর শরতের শুভ্র শীতল কোমল ব্রহ্মশক্তির পরিপূর্ণ আরাধনাকে দারিদ্র্য মুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রকাশ করেন বিভূতিভূষণ। এদিকে সংকট উত্তরণের শিক্ষা প্রদানকারী ব্রহ্মময়ী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা আমাদের বিবর্ণ চলচ্চিত্রে জাগ্রত করেছেন বিভাসিত উপলব্ধি। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’, ‘নৌকাডুবি’, ‘হীরের আংটি’ আর সত্যজিতের কালোত্তীর্ণ সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ আধুনিককালের দেবী দুর্গাপূজাকে ব্যাপকতা লাভ করিয়েছেন বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ও মিলনের উৎসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র হিসেবে।
দেশের প্রাচীনকালের পটশিল্প প্রধানত মঙ্গলকাব্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এই সব পটশিল্পের বহু ধারাই অনেক পুরনো। যেমনÑ শঙ্খশিল্প পাঁচ হাজার বছর আগেও ছিল বলে ধারণা করা যায়। আর টেপা-পুতুলের কাজও অন্তত চার হাজার বছর আগে ছিল বলে জানা যায়। বিষ্ণুপুরাণে দশমহাবিদ্যার উল্লেখ আছে এবং পরবর্তীকালে সেখান থেকেই দেবীর রূপ এবং বিষ্ণুর রূপ এসেছে পটশিল্পে। চ-ীমঙ্গল কাব্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মেদিনীপুরে চ-ীপটের কল্পনা করেন শিল্পীরা।
কলকাতার জাঁকজমকপূর্ণ বারোয়ারি দুর্গাপূজার অনেক আগে থেকেই দুর্গাকে বিভিন্ন রূপে বাঙালি উপাসনা করে আসছে। শুধু মাটির প্রতিমা হিসেবে নয়, শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলার এক অসামান্য লোকশিল্পের পরম্পরা। দেবী দুর্গা ঠাঁই পেয়েছেন কৃষ্ণনগরের অশীতিপর রেবা পালের চালচিত্র, মহীরুল চিত্রকরের চৌকো চ-ীপট, বিষ্ণুপুরের ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বিরল দুর্গাপট, দক্ষিণ দিনাজপুরের কাঠের পুতুল, নতুন গ্রামের নতুন সাজের কাঠের দুর্গা, ঠেকুয়া চকের বেণী-পুতুলের দুর্গা, বহরমপুরের শোলার দুর্গা, বিষ্ণপুরের শাঁখের ওপরে অসামান্য কারুকার্য করা দুর্গা।

মধ্যযুগে, দুর্গার চিত্রণ উগ্র ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাকে একজন যোদ্ধা দেবী হিসেবে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এবং রাক্ষস বধ করার জন্য। তাকে প্রায়ই সিংহ বা বাঘে চড়ে দেখানো হয়, যা শক্তি এবং হিংস্রতার প্রতীক। তার একাধিক বাহুতে তরবারি, ত্রিশূল, শঙ্খ, চাকতি, ধনুক এবং তীরের মতো বিভিন্ন অস্ত্রধারী চিত্রিত করা হয়েছে এবং তার মুখ উগ্র অভিব্যক্তিসহ দেখানো হয়েছে। ভারতীয় মিনিয়েচার পেইন্টিংগুলোতে দুর্গাকে প্রায়ই একাধিক অস্ত্র এবং বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেখানো হয়, অস্ত্র ধারণ করে এবং তার সন্তানদের সঙ্গে থাকে। এই চিত্রগুলোতে, তাকে প্রায়ই একজন শক্তিশালী এবং ভয়ানক দেবী হিসেবে চিত্রিত করা হয়, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।
মহামতি গৌতম বুদ্ধের সময় গড়ে ওঠে ভিক্ষুণী সংঘ। মাতা গোতমীর নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক নারী প্রবজ্জা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্ষুণী সংঘ। ভিক্ষুদের মতোই ভিক্ষুণীরা সমান মর্যাদায় ধর্ম প্রচারের সর্বোচ্চ সম্মান পান। নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার এটাই সর্বপ্রথম নিদর্শন। নারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লেখা ‘থেরীগাঁথা’ বুদ্ধ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বুদ্ধের অন্যতম অনুগামী ‘তারা’ তার জীবিত কালেই বুদ্ধের সমান খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কালচক্রযানী, প্রজ্ঞা ও পারমিতার সুষম অভিধায় ভূষিতা ‘তারা’ তিব্বত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ পূর্ব দীপ রাষ্ট্রগুলোতে বুদ্ধের মতোই আদরণীয়া। নারীর সৃজনে ও মননে আপন মহিমায় বিকশিত হওয়ার অনন্য প্রতীক এই ‘তারা’। এভাবেই দেবী দুর্গা সাহিত্য সংস্কৃতি চিত্রকলা থেকে প্রতিটি অংশে বিরাজমান। ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যে যুগ যুগ ধরে প্রবহমান ধারায় আজও বাঙালি সমাজে শারদীয় দুর্গোৎসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা ও আবৃত্তিশিল্পী

×