ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

ধ্বনিত হোক মঙ্গল বার্তা

অন্জন কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১০ অক্টোবর ২০২৪

ধ্বনিত হোক মঙ্গল বার্তা

মঙ্গল বার্তা

স্নিগ্ধ মুখর কণ্ঠে দূর থেকে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠের সুমধুর সুর কিংবা সুসজ্জিত প্যান্ডেল দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা প্রকাশ করে। কাশফুলের শুভ্রতা, শিশির  ভেজা শিউলি ফুল আর বাতাসে বদলে যাওয়া ঘ্রাণÑ সবই বার্তা দিচ্ছে শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজার। তিথির ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয় বলে বছরের কোনো নির্দিষ্ট তারিখে দুর্গাপূজা হয় না। প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের তিথিতে শুরু হয় দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা শুধু ব্যাপ্তিতে নয়, বৈচিত্র্যেও অনেক বিস্তৃত। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছে। মূলত, মানব সভ্যতায় ঈশ্বর বিশ্বাসীদের জন্য এই দেবীরূপের প্রকাশ অনেক প্রাচীন। সর্বপ্রাচীন যে গ্রন্থে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হলো ঋগে¦দ।
পরম ব্রহ্মের প্রকাশ ক্ষমতা জীব আত্মারূপে ধারণ করে। সাকার এবং নিরাকার উভয়রূপের মাঝেই শক্তির অবস্থান। শক্তির এই উপলব্ধি শিল্পীর ভাবনা বা কল্পনা প্রতিভার সাহায্যে কোনো বস্তু (পাথর, কাঠ, মাটি, ধাতু) রূপলাভের প্রতীক বা প্রতিমা হিসেবে বিবেচিত হন। সে কারণেই আমরা দেবীকে সাকার আরাধনা করি। মন্ত্রের মধ্যে  যে প্রতীকী ব্যঞ্জনা, যে চিত্রকল্প তা-ই প্রতিমারূপে বিনির্মিত।
পূজার আগমনী বার্তা জগৎ সংসারের সকল দুঃখ ও গ্লানি মুছে দিয়ে মানবমনে ধ্বনিত হয় মঙ্গল বার্তা। মঙ্গল হিতার্থে ব্রতী থেকেই প্রতি বছর পূজার মাধ্যমে শুরু হয়  দেবীর আরাধনা। ব্যক্তিগত পূজার পাশাপাশি সর্বজনীন পূজারও আয়োজন করা হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও দুর্গাপূজা তার বৈভব ও বিভূতি নিয়ে আমাদের দ্বারে সমাগত। দেবীর একই অঙ্গে বহুরূপ। যিনি দুর্গা তিনি কালী, আবার তিনিই জগদ্ধাত্রী, তিনিই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। কখনো তিনি দশভুজা আবার কখনো তিনি অষ্টভুজা। ভাগবত অনুসারে, দেবীর অষ্টভুজা রূপই যোগমায়া।
শাস্ত্রে শ্রীশ্রী দুর্গা দেবীর অনেক নামের মধ্যে মহাশক্তি, ব্রহ্মময়ী, আদ্যাশক্তি, নারায়ণী, চন্ডী, মহিষ-মর্দিনী, অসুর নাশিনী এসব নাম বিশেষভাবে পরিচিত। নামগুলোর প্রতিটি অর্থের মধ্যে একটি দর্শন, একটি অন্তর্নিহিত তত্ত্ব এবং মাহাত্ম্য রয়েছে।  পৌরাণিক মতে, বিশ্বের সব শক্তির মিলিত রূপ হলেন  দেবী দুর্গা। শ্রীশ্রী চ-ীতে বলা হয়েছে তিনি আদ্যাশক্তি ও সনাতনী। ব্রহ্মারূপে তিনি সৃষ্টি করেন, বৈষ্ণবী শক্তিরূপে পালন করেন। শিবানীরূপে বস্তুর পরিণতি বিধান করে মঙ্গল সাধন করেন। ‘মা দুর্গা’ নামটি মঙ্গলদায়িনী শক্তি হিসেবে আমাদের মননে গেঁথে রয়েছে।
শ্রীশ্রী চ-ী অনুসারে ‘নিঃশেষ দেবগণ শক্তিসমূহ মর্তাঃ।’ অর্থাৎ যিনি সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি তিনিই দুর্গা। তিনি ‘ত্রম্বকে’ অর্থাৎ ত্রিনয়না। দেবীর বাম চক্ষু হলো ইচ্ছে এবং চন্দ্র হতে উৎপত্তি। তার ডান চক্ষুটি কার্য এবং সূর্যের প্রতিভূ। দেবীর কপালের নয়ন হলো জ্ঞান এবং অগ্নির প্রতিভূ। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ যা অহংবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিনিধিত্ব করে দৃঢ় সংকল্পের। যখনই জগতে অসুর রিপুধারীদের অত্যাচারে সৃষ্টি অত্যাচারিত হয়, তখনই ভগবান নানা সময়ে নানারূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। নানারূপে অবতীর্ণ হয়ে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছেন। সে জন্য অসুরকে বিনাশ করে আসুরিক শক্তিকে ধ্বংস করেছেন।
একেক রূপের একেক মাহাত্ম্য নিয়ে দেবীর আগমন ঘটে। মহাভারতের যুদ্ধ  থেকে মহিষাসুর বধ পর্যন্ত তিনি বিরাজমান। সকল স্থানে মাতৃরূপে পূজিত হন বিশ্বজনীন মা দুর্গা। এই শান্ত-স্নিগ্ধ মাতৃরূপের পায়ের কাছে পড়ে থাকে রক্তের রেখা। মা দুর্গা ‘ত্রিশূলধারিণী’। মহিষের  দেহ ফুঁড়ে মহিষাসুরের বুকে বিঁধে থাকে ত্রিশূলের ফলা। এই ত্রিশূল তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং শূলপাণি শিব। শাস্ত্রে ত্রিশূলের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কখনো তিনটি গুণ স্বত্ব, রজ এবং তমগুণ প্রকাশ করে। কখনো সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে ত্রিশূলকে জাগতিক মায়া থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ব্রহ্মময়ী মা দুর্গা হলেন ব্রহ্মগুণের প্রতীক, যা শুদ্ধ স্বত্বগুণময়ী। পশুরাজ সিংহ রজোগুণের প্রতীক এবং অসুররাজ হলেন তমোগুণের প্রতীক। ব্রহ্মময়ী মা রজোগুণের সাহায্যে তমগুণকে বিনাশ করেন। এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, সকল দেহধারী জীবাত্মা স্বত্ব, রজ ও তমÑ এই তিন গুণের অধিকারী। স্বত্ব¡গুণ নির্মল জ্ঞানের অধিকারী হয়। রজগুণের ফলে লোভ জন্মে। তমোগুণ ভ্রান্তি ও অজ্ঞানতা হেতু উৎপন্ন হয়। তমগুণের ফলে বুদ্ধিনাশ হয়, বুদ্ধিনাশ হলে বিনাশ ঘটে।

তাই, পূজায় মায়ের নিকট চাওয়া হয় যেন সকলের মাঝে ব্রহ্মগুণ বা স্বত্ব¡গুণ উদয় হয়ে জগৎ সংসার কল্যাণময় হয়। যেন রজোগুণকে ব্রহ্মগুণ দ্বারা নিবৃত্তি করতে পারে, আর নিজের মাঝে স্থিত তমগুণকে নাশ করতে পারে। একজন মানুষ ব্রহ্মগুণী হলে ধর্ম ও  মোক্ষের  ডোরে অর্থ ও কামকে বাঁধতে শিখবে। তখনই ধর্ম, অর্থ, কাম ও  মোক্ষের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ে স্থিত হবে। এরূপ মনের অবস্থা হলেই কেবল জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের উপলব্ধি আসবে।
এ পূজার সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্ক অপরিসীম। শ্রীরামচন্দ্র জ্ঞানযোগ সাধনার পথপ্রদর্শক, শ্রী লক্ষ্মণ ভক্তিযোগের, রাজা ভরত কর্মযোগের ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘœ রাজযোগের প্রতীক। তাঁরা একে চার ও চারে এক। এই চারটি যোগের সাধনা সাধককে চারটি বেদের নিকট নিয়ে আসে। ঋগে¦দ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। তাই দুর্গাপূজা হলো মাতৃ আরাধনা ও সাধনা। শুধু উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়, চির আনন্দলোকের যাত্রী আমাদের সকলের আনন্দময়ী মা। দেবীর হাতে থাকা প্রজ্বলিত অগ্নি একদিকে  যেমন অস্ত্র,  তেমনি  দেবীর নিজস্ব শক্তিও প্রকাশ পায়। শাস্ত্রমতে, অগ্নি যাবতীয়  ক্লেদ থেকে জগৎকে পরিশুদ্ধ করে রাখে। তাই মনের আসুরিক শক্তি বিনাশ করে বলিয়ান হতে সকলে প্রার্থনায় মিলিত হয়ে বলিÑ
ওঁ অসতো মা সদগময়।/ তমসো মা জ্যোতির্গময়।/মৃত্যোর্মামৃতং গময়। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)/আবিরাবীর্ম এধি। (ঐতিরেয় উপনিষদ)/রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং, তেন মাং পাহি নিত্যম্।
Ñঅর্থাৎ, অসত্য থেকে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আমাকে  জ্যোতিতে/আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু  থেকে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও।  হে স্বপ্রকাশ; আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র,  তোমার  যে প্রসন্ন মুখ তার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা কর। সকল আসুরিক শক্তিকে ধ্বংস করে বিশ্ব সংসার জাগরিত হয়ে উঠুক মহামায়ার মঙ্গলময় শুভ বার্তা।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা

×