কুমারী পূজা বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপূজার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে ১৯০১ সালে শুরু হওয়া কুমারী পূজা বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপূজার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কুমারী পূজা হলো এক বিশেষ ধরনের পূজা, যে পূজায় এক কিশোরী কন্যাকে দেবীর আসনে বসিয়ে মাতৃরূপে পূজা-অর্চণা করা হয়। শঙ্খের ধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা, ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে কুমারী মাকে পুষ্পমাল্য পরিয়ে দেওয়া হয়। অষ্টমী তিথির পূজা শেষে হয় কুমারী পূজা। অষ্টমী ছাড়াও অনেক জায়গায় নবমীর দিনেও করা হয় কুমারী পূজা। কালী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, অন্নপূর্ণা পূজা এমনকি শক্তি পূজাতেও কুমারী পূজা করা হয় ।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মা কালীর হাতে কলাসুর বধের প্রতীকী হলো কুমারী পূজা। কথিত রয়েছে, কলাসুর স্বর্গ ও মর্ত্য অধিকার করে নিয়েছিল। দেবতারা মা কালীর কাছে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করেন। তাদের আর্তি শুনে মা কালী আবার জন্ম নেন শিশুকন্যা রূপে এবং কলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন, সেকালে মুনি-সাধকরা কুমারী পূজার মাধ্যমে প্রকৃতিকে পূজা করতেন। প্রকৃতি মানে নারী আর সেই প্রকৃতির আর এক রূপ কুমারীদের মধ্যে দেখতে পেতেন তারা। আর যাদের মন সৎ, কলুষতামুক্ত তাদের মধ্যে আবার ঈশ্বরের প্রকাশ বেশি। কুমারীদের মধ্যে এই গুণগুলো থাকে মনে করেই তাদের বেছে নেওয়া হয় এই পূজার দেবী হিসেবে।
এই পূজার বৈশিষ্ট্য হলো কুমারীকে পূজা করার সময় দেখা হয় না তার ধর্ম, জাত-পাত। এখনো ঋতুবতী হয়নি এমন ০১ থেকে ১৬ বছর বয়সী যেকোনো মেয়েই কুমারী হতে পারে। এমনকি বারবনিতার সন্তানও কুমারী রূপে পূজিত হতে পারে। বয়স অনুযায়ী কুমারীদের ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। ১ বছর বয়সী কন্যাকে সন্ধ্যা, ২ বছর বয়সী কন্যাকে সরস্বতী, ৩ বছর বয়সী কন্যাকে ত্রিধামূর্তি, ৪ বছর বয়সী কন্যাকে কালিকা, ৫ বছর বয়সী কন্যাকে সুভগা, ৬ বছর বয়সী কন্যাকে উমা, ৭ বছর বয়সী কন্যাকে মালিনী, ৮ বছর বয়সী কন্যাকে কুব্জিকা, ৯ বছর বয়সী কন্যাকে কালসন্দর্ভা, ১০ বছর বয়সী কন্যাকে অপরাজিতা, ১১ বছর বয়সী কন্যাকে রুদ্রানী, ১২ বছর বয়সী কন্যাকে ভৈরবী, ১৩ বছর বয়সী কন্যাকে মহালক্ষ্মী, ১৪ বছর বয়সী কন্যাকে পীঠনায়িকা, ১৫ বছর বয়সী কন্যাকে ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ১৬ বছর বয়সী কন্যাকে অন্নদা বা অম্বিকা বলা হয়।
কুমারী দেবী ভগবতীর অতি সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মা-ের সৃষ্টিকর্তী হয়েও চিরকুমারী। কুমারী আদ্যশক্তির মহামায়ার প্রতীক। দেবী দুর্গার আরেক নাম কুমারী। বিশ্বাস করা হয় কুমারী পূজা করলে সব বিপদ কেটে যায়। দার্শনিক মতে, কুমারী পূজা সমাজে মেয়েদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। কুমারীত্বকে মনে করা হয় শক্তির বীজ, সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের প্রতীক। নারীত্ব ও প্রকৃতির প্রতীক কুমারীত্ব। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। মনে করা হয় কুমারীর মধ্যেই নেমে আসেন মা।
কালের আবর্তে দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা অনেকাংশে হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুর মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদাদেবীর অনুমতিক্রমে কুমারীপূজার পুনঃপ্রচলন করেন। সব পূজা ম-পে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় না। ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বেশ জাকজমকপূর্ণভাবে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল ও যশোরের মঠের বিভিন্ন শাখায় অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা।
লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়