ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা

ড. সনজিত পাল

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১০ অক্টোবর ২০২৪

মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা

দশভুজা দেবী দুর্গা মায়াশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী

দশভুজা দেবী দুর্গা মায়াশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর কৃপায় সাধক যেমন সিদ্ধি লাভ করতে পারে, তেমনি তাঁর বরে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে পারে। মহাজ্যোতির্ময়ী, ত্রিনয়নী দেবীর কাছে সাধকের প্রার্থনা বা শরণাগতি যেমন হবে, সাধকের প্রতি দেবীর কৃপাও তেমন হবে। শ্রীশ্রী চ-ীগ্রন্থে (১/৭৫-৭৭) স্বয়ং ব্রহ্মা দেবী দুর্গার স্তুতি করে বলেছেন, ‘হে দেবী, আপনি এই জগৎ ধারণ করে রয়েছেন। আপনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন, আপনিই পালন করেন এবং প্রলয়কালে আপনিই এ জগতের সব কিছু সংহার করেন। হে জগৎস্বরূপা, আপনি এই জগতের সৃষ্টিকালে শক্তিরূপা, পালনকালে স্থিতিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা।

আপনি মহাবাক্যলক্ষণা ব্রহ্মবিদ্যা ও সংসৃতিকর্ত্রী মহামায়া। আপনি মহতী মেধা, মহতী স্মৃতি ও মহামোহ। আপনি মহতী দেবশক্তি ও মহতী অসুরশক্তি।’ শ্রীশ্রী চ-ীগ্রন্থের (১১/৫) নারায়ণীস্তুতিতে বলা হয়েছে, ‘হে দেবী, আপনি অনন্তবীর্যা বৈষ্ণবীশক্তি (বিষ্ণুর জগৎপালিনী শক্তি)। আপনি বিশে^র আদি কারণ মহামায়া। আপনি সমগ্র জগৎকে মোহগ্রস্ত করেছেন। আবার আপনি প্রসন্না হলে ইহলোকে শরণাগত ভক্তকে মুক্তি প্রদান করেন।’ 
আমরা সাধারণ মানুষ এমনি অধম যে জগন্মাতার কাছে কী প্রার্থনা করতে হয়, তাও জানি না। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমরা এ দুর্গতির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে সংসারের জিনিসই প্রার্থনা করে থাকি। প্রার্থনা আন্তরিক হলে দেবী আমাদের সে প্রার্থনা পূরণ করেন। কিন্তু সংসারের সে প্রার্থনা পূরণ হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারি যে, প্রার্থনাটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সেই প্রার্থনার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমাদের হয়তো একটি সাধারণ সমস্যা মিটল, কিন্তু নতুন প্রার্থনা আমাদের কাছে নতুন ও ভিন্ন ধরনের, আরও জটিল, গভীর ও মর্মান্তিক বিপদ এনে উপস্থিত করল।

তখন আমরা আবার বলে উঠিÑ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই। যাহা পাই তাহা চাই না।’ শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে সর্বসমক্ষে প্রার্থনা করে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, মাতৃরূপী ঈশ^রের কাছে কী প্রার্থনা করতে হয়। তিনি বলেছেন, ঈশ^রের কাছে ভক্তি, বিশ^াস, ভালোবাসা প্রার্থনা করতে হয়। রাজরাজেশ^রীর কাছে লাউ-কুমড়ো চাইতে নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ সকল প্রকার আমিভাব বা আমিত্যভাব ও অহংকার নিঃশেষে বিসর্জন দিয়ে মায়ের কাছে শরণাগত হয়ে প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘মা আমি তোমার শরণাগত, শরণাগত! দেহসুখ চাই না মা! লোকমান্য চাই না, অষ্টসিদ্ধি চাই না, কেবল এই করো যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি হয়Ñ নিষ্কাম অমলা, অহৈতুকী ভক্তি হয়।

আর যেন মা, তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হইÑতোমার মায়ার সংসারে, কামিনী-কাঞ্চনের উপর ভালোবাসা যেন কখনো না হয়! মা! তোমা বই আমার আর কেউ নেই। আমি ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীনÑকৃপা করে শ্রীপাদপদ্মে আমায় ভক্তি দাও।’ (শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতÑঅখ-) ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা প্রসঙ্গে মা সারদা বলেছেন, ‘নির্বাসনা প্রার্থনা করতে হয়। কেননা বাসনাই সকল দুঃখের মূল, বারবার জন্ম-মৃত্যুর কারণ, আর মুক্তির অন্তরায়।’ স্বামী বিবেকানন্দ প্রার্থনা করলেনÑ‘হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।’
মানব আকাক্সক্ষার সঙ্গে কামনা-বাসনার সম্পর্ক খুব গভীর। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বাসনাও বাড়তে থাকে। বয়স বেশি হলে জীবন থেকে বাসনা ত্যাগ করা যায় না। এর জন্য চাই শৈশব, কৈশোর ও যৌবন থেকেই নিরলস প্রচেষ্টা। বৃদ্ধ বয়সে মুখে বলিরেখা দেখা দেয় বা মুখের চামড়া কুচকে তাতে ভাঁজ পড়ে যায়। মাথার চুল সাদা হয়ে যায়। গাত্র শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু ভোগবাসনা তারুণ্য লাভ করে। দিন দিন এই ভোগের ইচ্ছা আরও বাড়তে থাকে। আশারূপ রাক্ষসী, আশারূপ বিষমঞ্জরী ও আশারূপ জীর্ণমদিরা সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলে। এই তৃষ্ণা, এই ভোগেচ্ছা বেড়ে গিয়ে মানুষকে চরম যন্ত্রণা দান করে।

আমাদের চিত্ত বিভ্রাট ঘটায়। শ্রীশ্রী চ-ীগ্রন্থে (১/৫৫-৫৬) বলা হয়েছে, ‘দেবী ভগবতী মহামায়া বিবেকিগণের চিত্তসমূহকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। তিনি এই সমগ্র জগৎ সৃষ্টি করেন। তিনি প্রসন্ন হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য কাক্সিক্ষত বর দান করেন।
দেবী দুর্গা মহামায়া নামে যেমন পরিচিত, তেমনি তাঁর আরেকটি নাম রয়েছে যোগমায়া। বৈষ্ণব আরাধনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গা এই উভয় শক্তিরই অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দুর্গা। অন্তরঙ্গা উপাসনায় কৃষ্ণভক্তি প্রাপ্তি এবং বহিরঙ্গা শক্তির উপাসনায় জড়জাগতিক বৈভব প্রাপ্তি হয়ে থাকে। যিনি যা কামনা করবেন তাঁর সেই শক্তির উপাসনা করা হয়। ‘ধন দাও, যশ দাও, পুত্র দাও, সরকারি চাকরি দাও, সুন্দরী স্ত্রী দাও, ডিগ্রি পাস, জমিজমা ভোগ, রাজত্ব, মন্ত্রিত্ব’Ñ এই রকম কিছু বাসনা নিয়ে দুর্গাপূজা করলে দুর্গা   দেবী বহিরঙ্গা মহামায়া রূপে মনোবাসনা পূর্ণ করেন।

যে শক্তি জড়জাগতিক ভোগ্যবস্তু দিয়ে জন্ম-মৃত্যুর আবর্তন থেকে মুক্তির পথ ভুলিয়ে রাখতে সহায়তা করেন, সেই শক্তিই মহামায়া। দুর্গা দেবীর অন্য নাম কাত্যায়নী দেবী। বৃন্দাবনের গোপবালিকাগণ কাত্যায়নী দেবীর আরাধনা করেছিলেন কোনো জাগতিক কামনা-বাসনা লাভের জন্য নয়। তাঁদের আরাধনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করা। 
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই কথাটিই বলেছেন। তাঁর প্রার্থনায় কোনো জাগতিক ভোগ-বাসনা ছিল না। ছিল দেবীর কৃপা প্রার্থনা করা। শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী সন্তুষ্ট হলে মানুষের শ্রেষ্ঠ আকাক্সক্ষা আত্মার মুক্তি লাভ সম্ভব হয়। দেবী দুর্গার মায়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব সহজ নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৭/১৪) বলেছেন, ‘আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তাকে কেউই সহজে অতিক্রম করতে পারে না।’

যারা জড়জাগতিক সম্পদ উপভোগের উদ্দেশ্যে দুর্গাপূজা করেন, দেবী মহামায়া রূপে তাদের মায়ার বাঁধনে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আটকে রাখেন। তারা মৃত্যুময় ভবচক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে না। মহামায়া দেবী দুর্গা এমন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি অপহরণ করেন। তাই ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্য দিয়েই আত্মিক মুক্তির দিকে ধাবিত হতে হবে। আর এই ধাবিত হওয়ার চেষ্টা শৈশব থেকেই শুরু করতে হবে।
সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন। যাতে জাগতিক বাসনা ও মোহ আমাদের অভিভূত করতে না পারে। যাতে আমরা মায়ার নিগড়ে আরও বেশি বদ্ধ না হই। আমরা যারা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ আছি, আমাদের পরিত্রাণ করতে পারেন এই মহামায়া। সেই মহামায়া শরতে বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিত হওয়ার জন্য এসেছেন। শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়েও তিনি আজ বাঙালির ঘরের মেয়ে। স্বামীর বাড়ি থেকে সিদ্ধিদাতা গণেশ, দেবশক্তির পরিচালক কার্তিক, বিমল বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী, ঐশ^র্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে নিয়ে দেবীপক্ষ শুরু হওয়ার পর বাবার বাড়ি বাঙালির ঘরে দশমী পর্যন্ত বিরাজ করবেন তিনি।

আমরা যদি সদাচারের মাধ্যমে আমাদের মন-প্রাণকে নির্মল করতে পারি, শুদ্ধ-পবিত্র করতে পারি, তাহলে নির্মল ও বিশুদ্ধ মনরূপ দেবমন্দিরে মাকে অধিষ্ঠিত হওয়ার কাতর প্রার্থনা জানাতে পারি। মা, তুমি আমার হৃদয়টিকে মন্দির বা কৈলাসে রূপান্তরিত করে সেই হৃদয়-মন্দিরে অবস্থান করে আমৃত্যু অন্তরের অন্ধকার দূর করো। তোমার আলোয় আলোকিত হোক আমার সংসার ও সমাজ। তোমার শক্তিতে পরাজিত হোক সকল অশুভ শক্তির। তোমার জাগরণে বিরাজ করুক সকল শুভ ও কল্যাণ। জয় দেবী দুর্গতিনাশিনী।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, প্রাক্তন সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়

×