ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

হাসান বাসরীর (রহ.) জীবন কথা

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:২৭, ১০ অক্টোবর ২০২৪

হাসান বাসরীর (রহ.) জীবন কথা

প্রসঙ্গ ইসলাম

হযরত হাসান বাসরী (রহ.) মদিনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিদ্বান ও অতিশয় ধর্মভীরু হিসেবে বিশ্ব সমাজে সমাদৃত। তার সম্পর্কে বিখ্যাত জীবনীকার ইবনে সা’দ লিখেছেন : হাসান বাসরী বহু পুণ্যত্ব ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। অতি বড় আলিম ছিলেন, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন, ইসলামী আইনবিদ ছিলেন, ফিতনা হতে সুরক্ষিত ছিলেন, বড় ইবাদত গুজার ও পরহেযগার ছিলেন, বিপুল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, শুদ্ধভাষী, মিষ্টভাষী, সুন্দর ও অমায়িক ছিলেন, বিশেষভাবে ইলমে হাদিসে তার গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল।

হাফেজ যাহ্বীর ভাষায় তিনি ছিলেন বড় বিজ্ঞ, ইলমের সমুদ্র। তিনি হযরত ওসমান, আবু মুসা আশআরী, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আনাস ইবনে মালিক (রা.) প্রমুখ সাহাবীর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার মাতা ছিলেন হযরত উম্মুল মোমেনীন উম্মে সালমার একজন বাঁদি সেবিকা । যখন তার মা গৃহকার্যে ব্যস্ত থাকতেন এবং যখন তিনি ক্ষুধায় কাঁদতেন, তখন নবী পতœী উম্মে সালমা (রা.) স্নেহে তাকে কোলে নিয়ে নিজ স্তন্য দান করতেন।

শৈশবকালে তিনি একবার উম্মুল মোমেনীন হযরত উম্মে সালমার গৃহে রাসূলুল্লাহর পবিত্র পানপাত্র হতে পানি পান করেন। কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ (সা.) পানি কে পান করেছে জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে হযরত উম্মে সালমা হাসানের নাম বললেন। হযরত বললেন, সে যে পরিমাণ পানি পান করেছে, সে পরিমাণ জ্ঞান তার লাভ হবে। 
কথিত আছে, হযরত হাসান জন্মগ্রহণ করলে তাকে হযরত ওমরের (রা.) কাছে হাজির করা হয়। হযরত ওমর তাকে দেখে বললেন, এই বালকের মুখম-ল হুস্ন্ অর্থাৎ সুশ্রী, সুতরাং এর নাম হাসান রেখো। সেই মতে তার নাম হাসান রাখা হয়। বিবি উম্মে সালমাও শৈশবে তাকে যতেœর সঙ্গে প্রতিপালন ও দোয়া করেছিলেনÑ হে আলাহ! তাকে একজন যোগ্য ইমাম করো, যাতে সারা জগতের মানুষ তার একতেদা (অনুসরণ) করে। হযরত হাসান অন্তত ১৩০ জন সাহাবার ছোহবত লাভ করেছিলেন। হযরত আলীর (রা.) সঙ্গে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল এবং তার নিকট থেকে হাসান শিক্ষালাভ করেছিলেন। হযরত আলীর (রা.) পবিত্র হস্তে তিনি মুরীদ হন। 
হযরত হাসানের প্রথম মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে বলা হয়, হাসান মণি-মাণিক্যের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা উপলক্ষে একবার তিনি রোম নগরে গমন করেন। রোমের একজন উজিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। একদিন উক্ত উজিরের অনুরোধে তিনি নগরের নিকটবর্তী কোনো স্থানে তার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যান। সেখানে গিয়ে এক সুসজ্জিত সুবৃহৎ স্বর্ণ ও মণি-মাণিক্যখচিত তাঁবু প্রতিষ্ঠিত দেখতে পান। একদল সুসজ্জিত সৈন্য তাঁবু প্রদক্ষিণ করে তাদের ভাষায় কি বলতে বলতে চলে গেল। এর পর প্রায় ৪শ’ বিদ্বান ও প-িত এসে পূর্বের ন্যায় তাঁবু প্রদক্ষিণ করে কিছু বলতে বলতে চলে গেলেন।

এরপর আসলেন বৃদ্ধ মুরব্বি শ্রেণি। পরক্ষণেই প্রায় ২ শতাধিক সুন্দরী বাঁদির প্রত্যেকে বহু মূল্যবান মণি-মাণিক্যপূর্ণ থালা মস্তকে ধারণ করে তাঁবু প্রদক্ষিণ করে কি বলতে বলতে চলে গেল। সবশেষে রোম সম্রাট স্বয়ং ও তার উজির তাঁবুর ভেতর প্রবেশ করে কিছুক্ষণ পর বের হয়ে গেলেন। হযরত হাসান বলেন, আমি এটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম এবং উজিরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। উজির বললেন, এই সম্রাটের এক পরম সুন্দর গুণবান কুমার ছিলেন।

সম্রাট তার প্রতি অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন। হঠাৎ কুমার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা তার চিকিৎসায় অকৃতকার্য হলেন। ফলে কুমার মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। তাকে এই তাঁবুতেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। বাদশাহ বছরে একদিন মহাআড়ম্বরে তার সমাধি দর্শন করতে আসেন। আজ সেই দিন। 
আপনি প্রথমে যে সেনাদলকে তাঁবু প্রদক্ষিণ করতে দেখতে পেয়েছেন, তারা বলেছে, হে রাজকুমার! তোমার যে অবস্থা ঘটেছে, আমাদের বাহুবলে যদি তা দূরীভূত করা সম্ভব হতো, আমরা জানে-প্রাণে চেষ্টা করে তোমাকে মুক্ত করতাম। কিন্তু যিনি এর সংঘটক, তার সহিত কোনো যুদ্ধ চলে না। বিদ্বানম-লী এসে বলেছেন : হে রাজকুমার! যদি আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও পা-িত্যের বলে এ দুঃখ দূর করা সম্ভবপর হতো, তবে আমরা তোমার জন্য তা করতাম। সম্মানিত বৃদ্ধগণ এসে বলেছেন : হে যুবরাজ! যদি সুপারিশ ও ক্রন্দন দ্বারা তোমার জীবন রক্ষা করতে পারতাম তবে আমরা কখনো তা থেকে বিরত হতাম না।

পরে সুন্দরী দাসীগণ রতœপূর্ণ থালা মস্তকে ধারণ করে এসে বলল, হে প্রভু! যদি ধনরতœ ও সৌন্দর্য দ্বারা তোমাকে রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো তবে তোমার জন্য এই ধনরাশি উৎসর্গ করতাম। কিন্তু যিনি এ ঘটনার সৃষ্টি করেছেন, তার নিকট ধনরতœ ও রূপলাবণ্যের কোনো মূল্য নেই। সবশেষে সম্রাট অগ্রসর হয়ে বললেন, হে প্রাণাধিক পুত্র! তোমার পিতার হাতে আর কি শক্তি আছে? আমি তোমার জন্য সৈন্যদল, বিদ্বান, বৃদ্ধ পুরুষ, রূপলাবণ্যময় দাসী ও মহিলাগণকে হাজির করেছি এবং আমিও স্বয়ং এসেছি।

সৈন্যদল, পা-িত্য, ধন-সম্পদ এবং সৌন্দর্যের সাহায্যে যদি এই বিপদ দূরীভূত করা সম্ভবপর হতো, তাহলে সর্বশক্তি দ্বারা তোমার প্রাণরক্ষার চেষ্টা করতাম। কিন্তু যিনি এটা করেছেন, তোমার পিতা এবং সমস্ত পৃথিবী তার বাহুর নিকটে সম্পূর্ণ দুর্বল। এই বলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাদশাহ বের হয়ে আসলেন। উৎসবটি এক নির্দিষ্ট দিবসে প্রতিবছর এই স্থানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। উজিরের এই সমস্ত কথা হযরত হাসানের অন্তরে অনুতাপের ভাব দৃঢ় করে তোলে। তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন এবং স্বীয় ব্যবসা ত্যাগ করে পরকালের চিন্তায় অধীর হয়ে বসরায় চলে যান। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনো এই নশ্বর এবং পাপপূর্ণ সংসারের মোহে পতিত হবেন না। তখন হতে তিনি এবাদত ও রেযাযাতে এরূপ আত্মনিয়োগ করলেন যে, তৎকালে তাহার ন্যায় কঠোর রেযাযাতে আর কাউকেও দেখা যায়নি। 
হযরত হাসান বাসরীর কারামত বর্ণনা করতে গিয়ে তার জীবনীকার আবদুল্লাহ বলেন, একদিন হযরত হাসান নিজ বন্ধুদের বললেন, তোমরা প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহাবাদের ন্যায়। এটা শুনে তারা অতিশয় আনন্দিত হলেন। হযরত হাসান বললেন, চেহারা, আকৃতি ও দাড়ির দিক দিয়েই শুধু, অন্য প্রকারে নয়। যদি তোমরা তাদের দেখতে, তবে তোমাদের চোখে তাদের পাগল বলেই প্রতীয়মান হতো। অপরদিকে তারা যদি তোমাদের অবস্থা জানতেন, তবে তোমাদের একজনকেও তারা মুসলমান বলতেন না। তারা ছিলেন ওস্তাদ ঘোড়সওয়ার; তারা বাতাস ও পাখির মতো বেহেশতের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর আমরা দুর্বল ও আহত গর্দভের পৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে ধীরে ধীরে চলতে চলতে পশ্চাতে পড়ে আছি।
বর্ণিত আছে, হাসান বাসরী মোনাজাতে বলতেন, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে নিয়ামত দান করেছ। কিন্তু আমি তার শুকরিয়া আদায় করিনি। তুমি বিপদ দিয়েছ। কিন্তু আমি সবর করিনি। শুকরিয়া আদায় করিনি বলে তুমি আমার নিকট থেকে নিয়ামত কেড়ে নাওনি। সবর না করার দরুন তুমি আমার বিপদকে চিরস্থায়ী কর নাই। হে খোদা! তোমার মধ্যে বদান্যতা ও রহমত ছাড়া আর কিছুই নেই। তাযকেরাতুল আউলিয়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে, হযরত হাসানকে কেউ কখনো হাসতে দেখেননি। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েছেন, তখন সর্বপ্রথম তাকে হাসতে দেখা গিয়েছিল। 
জনৈক কবি সত্যিই সুন্দর বলেছেন : 
এমন জীবন হইবে তোমার করিতে গঠন;
মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।
১০ অক্টোবর, ৭২৮ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চাসন দান করুন। আর আমাদের তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের ও ফয়ুজাত হাসিলের মানসিকতা সৃষ্টি করুন। 

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×