সম্পাদকীয়
অন্তর্বর্তী সরকার ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পুলিশ বিভাগে সংস্কার, যার পোশাকি নাম পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের প্রধান হয়েছেন সফর রাজ হোসেন, যিনি একজন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব। ৩ অক্টোবর গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে রবিবার। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে জানান, পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রাথমিকভাবে দেড় শত বছরের পুরনো পুলিশ আইন ও বিধিমালা সংশোধনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এখনো সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল বিশেষ করে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এসব আইন সেকেলে ও পুরনোÑ নির্যাতন ও নিপীড়নমূলক। এগুলোতে এতদিন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এসব আইনে প্রয়োজনে সংশোধন, গ্রহণ, বর্জন শেষে আধুনিক ও সময়োপযোগী করা হবে। যাতে সেগুলো যথার্থ অর্থে গণমুখী ও জনসেবামূলক হতে পারে।
সেজন্য ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুধীজনের সঙ্গে, যারা আইনগুলো নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে। সংস্কারবিষয়ক প্রশ্নগুলো ওয়েবসাইটে দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে, যেখানে অংশীদাররা তাদের মতামত দিতে পারবেন। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কিভাবে কাজ করে, সেসব সম্পর্কে ধারণা নিয়ে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে তুলে ধরা হবে সংস্কার প্রস্তাব। উল্লেখ্য, সংস্কার প্রস্তাবের জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে কমিশনকে।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। যার ফলে, বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। আহতদের অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন। এ ছাড়াও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণ, আয়নাঘর, দলবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগ তো আছেই। সে অবস্থায় পুলিশ বাহিনীর ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত হলো শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের ওপর সমাজ নির্ভরশীল। বিশেষ করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুলিশের ওপর সাধারণ নাগরিকরা যেমন ভরসা করেন, তেমনি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও অন্ত নেই। পুলিশের দায়িত্বহীনতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশ্ন তোলা হয়ে থাকে।
পুলিশের ভালো কাজ ছাপিয়ে তার দুর্নীতি ও কিছু গর্হিত অপরাধের কথা ফলাও করে প্রচারিত হওয়ার অপসংস্কৃতি থেকে সমাজ বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে, সমাজে পুলিশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, তা মোটেও সম্মানজনক নয়। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ অপরাধীর পেছনে ছোটে- পুলিশের পেশার এই বৈশিষ্ট্যের দিকে সমাজের সহানুভূতির দৃষ্টি তেমন নেই। সে অবস্থায় পুলিশের সুনাম বাড়ুক নিপীড়নকারী হিসেবে নয়, জনগণের সেবক হিসেবে। আগামী দিনের পুলিশ হয়ে উঠুক জনবান্ধব, সমাজবান্ধব- এমন প্রত্যাশা দেশের সর্বস্তরের নাগরিকের।