সিডনির মেলব্যাগ
বাঙালির শারদ উৎসব দেশের পাশাপাশি বিদেশেও জমজমাট। আমি যখন সিডনি আসি তখন সাকল্যে দুই কি তিনটি পূজা হতো। পরে তা বাড়তে বাড়তে এখন অসংখ্য বললেও ভুল বলা হবে না। এ কথা হলফ করে বলতে পারি দেশ ছাড়ার সময় নাড়িতে দেশের যে বিষয়গুলো সঙ্গে নিয়ে আসি আমরা, তার একটির নাম আচার। এই আচার সংস্কৃতি ধর্ম এবং জীবনে এমন প্রভাব বিস্তার করে আছে, যা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। সত্যি বলতে কি আর কোনো জাতিসত্তার ভেতর এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না।
আমাদের পাশের বঙ্গের বাঙালিরাও আছেন এখানে। ভালোভাবেই আছেন। তাদের সচ্ছলতা এবং আর্থিক সামর্থ্য আমাদের চেয়ে কম নয়। বরং বেশি হতে পারে। তারপরও তারা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বা অন্য কোনো বিষয়ে বড় কোনো আয়োজন করেন না। ঘরের কোনায় পালন তো সকলেই করতে পারে। কিন্তু আমাদের বেলায় ঘটনা ভিন্ন। আমাদের দেশের মানুষ যে যেখানে সেখানেই সাড়ম্বর উদ্যাপন। সিডনিতে বঙ্গবন্ধুর নামে তিন বা ততোধিক সংগঠনের বৈশাখী মেলা এখন প্রতি বছরের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ বা শোকের জন্য কোনো আয়োজন না করলেও মেলা তারা করবেই।
একদিকে লাভ, অন্যদিকে উদ্যাপনের নেশা। যে কথা বলছিলাম, পূজা এখন সিডনিতেও শারদীয় উৎসবের রূপ ধারণ করেছে। এতটাই যে সবগুলো দল-উপদল মিলে একাধিক বিজয়া সম্মিলনীরও আয়োজন হচ্ছে আজকাল। প্রথমবার তারা আমাকে অতিথি করে ডেকেছিলেন। গিয়ে বুঝেছিলাম শক্তি শব্দটি আসলে ঐক্যের ভেতর থাকে। বিচ্ছিনতায় তার দেখা মেলে না। বাংলাদেশের বড় শক্তি সংস্কৃতি। সেটা যারা আত্মস্থ করতে পেরেছে, তাদের জয় সময়ের বিষয়। বাঙালির বড় সৌভাগ্য, সে সংস্কৃতি আর পূজাকে এক করে নিয়েছে। মূলত সংস্কৃতিই পূজাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
শঙ্খ থেকে বাদ্য, বাদ্য থেকে গান সব মিলিয়ে যে জমজমাট পূজা, তাকে শুধু ভক্তি রসে ভাসানোর কাল শেষ। সামনে দুটি কর্তব্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে পাঠ দান করা নিজেদের ধর্ম বিষয়ে অবগত করানো। যারা অতি আধুনিক হওয়ার নামে তা করেন না, তারা শিকড়হীন। শিকড় ছাড়া কোনো গাছ বাঁচে না। আমাদের শিকড়ে যেতেই হবে। অন্য কোনো পথ খোলা নেই সামনে।
বিদেশের বাঙালির দায় আরও বেশি। সে বসবাস করে নিরাপদ গণতান্ত্রিক ভূমিতে। তার জীবনে সচ্ছলতা বা আনন্দের পাশাপাশি আছে নিরাপত্তা। আমরা জানি, সঙ্কীর্ণতা আর স্বার্থপরতায় কতটা পটু বাঙালি হিন্দু। এখন তা পরিহারের সময় সমাগত। আপনি একা ভালো থাকতে পারবেন না। আপনার সংঘবদ্ধ জীবনে যাদের দরকার, তাদেরও ভালো রাখতে হবে। এই ভালো লাগা দেশ-কাল সীমানার গ-ি পেরিয়ে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা। আপনার আত্মীয়-পরিজন খারাপ থাকলে আপনি কিভাবে ভালো থাকবেন? এসব কথা মাথায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে পূজার আয়োজন আর কল্যাণের পথে আসুন ।
মা দুর্গা যে অসুরকে বধ করেছিলেন, তার প্রতীক আপনার চোখের সামনেই আছে। আপনার সমাজ ও বাস্তবতায় এর চেয়ে বড় বড় অসুর আছে, যারা সব গিলে খাচ্ছে, খাবে ভবিষ্যতে। দুর্গা নিশ্চয়ই মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে সাহায্য করবেন না। তিনি আপনাকে যে অভয় দিয়েছেন বা দেবেন, যে সাহস দেবেন, যে শৌর্য দেবেন, তাতেই শক্তি। তাকে পুঁজি করে এগোলেই পূজার সার্থকতা হবে শতভাগ। আবারও বলছি, শান্তি আমাদের জন্মগত প্রক্রিয়া। বাঙালি হিন্দু চাইলেও সহিংস হতে পারে না। এটা শান্তি ও সভ্যতার জন্য মঙ্গলের। আমরা সে শান্তির জন্যই কঠোরভাবে নিজেদের জানতে চাই। পরিচিত হতে চাই সে সত্যের সঙ্গে, যার ভেতরে নিজেদের সুরক্ষা পাওয়া যায়।
প্রবাসে শারদীয় উৎসব শরৎকালে হয় না বটে, কিন্তু আমেজে তার কোনো কমতি থাকে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ শামিল হন। এই মিলনের ভেতর আন্তর্জাতিকতাও নিজের জায়গা করে নিয়েছে। আগে যারা অতিথি হয়ে আসতেন বিশেষ করে অজি বা সাদা লোকজন, তাদের বোঝানো হতো কী এই পূজা। বা কি এর উপযোগিতা। বাংলাদেশের সব উৎসবেই এমন পাঠদান করা ছিল জরুরি। এখন তার আর দরকার পড়ে না। এখন তারাই জেনে আসে। এসে জানার কথা বলতে পছন্দ করে। এই যে ঘুরে দাঁড়ানো এটাই আমাদের শক্তি। এই শক্তি কোনো বিভেদ বা বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাস করে না।
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ধার্মিক না। আমার ভাবনায় মানুষই প্রথম। মানুষ আছে বলেই এত আয়োজন। এত সুন্দর সব। তাই ভেদাভেদের ওপরে উঠে একত্রিত আনন্দের নামই উৎসব। বাংলাদেশের জন্য আজ এর কোনো বিকল্প নেই। কথা, কাজ আর বিশ্বাসে আমাদের বিভক্তি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। প্রয়োজন থাক বা না থাক, প্রবাসী বাঙালিও এর থেকে দূরে থাকতে পারেনি। পারবেও না। পারার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু কে কতটা যাবেন বা যাওয়া উচিত, তার একটা মানদ- থাকা দরকার। আমরা এসব দেশে থেকে এটুকু বুঝেছি জেনেছি যে, বহু মত আর পথের নামই সহাবস্থান। জীবনযাপনে তা মেনে চলতে হয় এই দেশে। তা হলে নিজেদের বেলায় কেন তা মানব না?
শারদ উৎসব সে মান্যতার একটা পথ খুলে দেয়। শরতের মতো নির্মল পবিত্র আর ভালোবাসার ঋতু দ্বিতীয়টি নেই। কবি, লেখক, শিল্পীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনেও দোলা দিক সর্বজনীনতা। হানাহানি মারমারির বাইরে আমাদের যে জগৎ, তার পথ আবার খুলে যাক। বাংলাদেশের যে সব মানুষ দেশের বাইরে থাকেন, তারা জানেন দেশ ও পরিবেশ ছেড়ে আসা কতটা কষ্টের।
যে কষ্ট কিছুটা লাঘব করে ঈদ-পূজা-নববর্ষের মতো আনন্দঘন উৎসবগুলো। সে আনন্দ যেন ম্লান না হয়। সিডনি সবসময় বাঙালি বিশেষত বাংলাদেশীদের পদচারণায় মুখর। আজ-কাল-পরশু সবসময় কোনো না কোনো উৎসব লেগেই আছে। মাঝে মাঝে রাজনীতি থাবা বিস্তার করলেও মূলত অন্তহীন আনন্দ প্রবাহই মানুষের কাম্য। শারদীয় দুর্গাপূজাকে তাই তো বলি শারদ উৎসব। যাতে সে সবার মনে আনন্দের ধারা বইয়ে দিতে পারে।