ডিজিটালি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানে হলো কম্পিউটার সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার
‘ভার্চুয়াল’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো অপার্থিব (অর্থিব) আর ‘রিয়েলিটি’ হলো বাস্তবতা। কিন্তু ডিজিটালি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানে হলো কম্পিউটার সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার দিয়ে তৈরি কৃত্রিম পরিবেশনা, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের ন্যায় চেতনা উদ্রেককারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বলে। এটি মূলত কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিমুলেশন বা মডেলিংয়ের মাধ্যমে এমন একটি কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে একজন ব্যবহারকারী তার আশপাশের পরিবেশের মতোই সবই জীবন্ত উপলব্ধি করতে পারে। যেমন- বাস্তবে কখনোই বন্যপ্রাণী মহাকাশে উঠতে পারে না।
কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে দর্শককে তা বাস্তবের চাইতেও জীবন্ত দেখানো হয়। বিভিন্ন এনিমেশন মুভি বা থ্রি-ডি গেমের সংস্পর্শে গেলেই দেখা যায় এমন বাস্তবতা। হলিউডের মতো বড় বড় ফিল্ম স্টুডিওর বিশ্ব চলচ্চিত্রে, বিজ্ঞাপন ফার্মে এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে মানুষের সৃজিত নিউরাল ইন্টারফেস বা মানব-মেশিন সংস্পর্শের সৃষ্টি করে তথা মানুষের মধ্যে অভিজ্ঞতা অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করে।
প্রযুক্তিটি এমন একটি থ্রিডি বা ইমার্জিভ অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে, যা ব্যবহারকারী প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো অনুভব করতে পারে। তবে এগুলোকে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করার জন্য কিছু টুলস এবং ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়। যেমনÑ ১. হাতের ডেটা গ্লোভ, ২. বডি স্যুট, ৩. মাথায় হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে, ৪. ইফেক্টর, রিয়েলিটি সিমুলেটর, সফটওয়্যার এপ্লিকেশন ইত্যাদি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সঙ্গে সংযোগ সাধনে ইফেক্টর হিসেবে হাতের ডেটা গ্লোভ, বডি স্যুট ও মাথায় হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয়। রিয়েলিটি সিমুলেটর ইফেক্টরকে সংবেদনশীল তথ্য দেওয়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন সেন্সরগুলোকে উত্তেজিত করে। এই সবের পেছনে কাজ করে সিমুলেশন সফটওয়্যার এপ্লিকেশন। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাধারণত ৫ ধরনের হয়ে থাকে। যেমনÑ ১. সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত (Fully-immersive): প্রকৃতি ও পরিবেশের অকল্পনীয় জগতের অনুভূতি পেতে এক বিশেষ কৃত্রিম পরিবেশ (Artificial environment) তৈরি করে যা দেখে ব্যবহারকারী তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। যেমন- সমুদ্রের তলদেশে তিমি মাছের দেখা কিংবা জঙ্গলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টার্জেনের মতো উড়ে বেড়ানো সবই পরিপূর্ণভাবে অনুভব করা যায়।
২. সেমি-ইমার্সিভ (Semi-immersive): Fully-immersive I Non-immersive-এর মাধ্যমে তৈরি হয় semi-immersive। কম্পিউটারের মাধ্যমে ও মাউসের সাহায্যে character-এর বৈশিষ্ট্য নিজের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারা। ৩. নন-ইমার্সিভ (Non-immersive)- সফটওয়্যারের মাধ্যমে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করা হয়। ব্যবহারকারীরা অ্যানিমেশন বা গেমস খেলার মাধ্যম নন-ইমার্সিভের বিষয়টি উপভোগ করতে পারে। ৪. অগমেন্টেড রিয়েলিটি হলো একটি ইন্টারেক্টিভ অভিজ্ঞতা, যা কম্পিউটার-জেনারেটেড ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্য দিয়ে বাস্তব জগতকে উন্নত করে।
সফ্টওয়্যার, অ্যাপস এবং হার্ডওয়্যার (যেমন- অজ চশমা) ব্যবহার করে অগমেন্টেড রিয়েলিটি ডিজিটাল কন্টেন্টকে বাস্তব জীবনের পরিবেশ এবং বস্তুর ওপর ওভারলে করে। ৫. কোলাবোরেটিভ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ঈড়ষষধনড়ৎধঃরাব ঠজ) Ñ এটি একটি সহযোগিতামূলক ভার্চুয়াল পরিবেশ, যা অনেক অংশগ্রহণকারীর সহযোগিতা এবং মিথস্ক্রিয়া করার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এর প্রভাব বড় দূরত্বে ছড়াতে পারে। সাধারণত বিতরণকৃত সিমুলেশন, থ্রিডি মাল্টিপ্লেয়ার গেমস, পাবজি (চটইএ) গেম, সহযোগী প্রকৌশল সফ্টওয়্যার, সহযোগী শিক্ষার অ্যাপ্লিকেশন এবং অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনগুলো সাধারণত ভাগ করা ভার্চুয়াল পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ১. বিনোদনÑ এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবহার হলো গেমিং। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির গেমগুলো ব্যবহারকারীদের একটি সম্পূর্ণ নতুন জগতে নিয়ে যায় এবং তাদের একটি অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এছাড়াও সিনেমা, ভিডিও এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সামগ্রী তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ২. শিক্ষাÑ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দূরবর্তী স্থানগুলো ভ্রমণ করতে পারে, ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো পুনর্জীবিত করতে পারে এবং এমনকি জটিল ধারণাগুলোকে আরও সহজে বুঝতে পারে।
শিক্ষকরা তাদের পাঠদান ভার্চুয়ালি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করেন প্রজেক্টরের সাহায্যে। এতে তারা প্র্যাকটিকাল উপায়ে সব শিখতে পারছে। ৩. চিকিৎসাÑ মেডিক্যাল শাখায় জটিল সার্জারি বা রোগ নির্ণয়ে বর্তমানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এক বিশাল জায়গা দখল করে আছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অনেক অ্যাপ্লিকেশন আছে, যেগুলোর মাধ্যমে ব্যথা উপশম করতে, আতঙ্কজনিত ব্যাধিগুলোর চিকিৎসা করতে, এমনকি অস্ত্রোপচারের আগে রোগীদের প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হয়।
সিমুলেটেড সার্জারির মাধ্যমে নতুন ডাক্তার কিংবা মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। ৪. প্রশিক্ষণÑ প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে কর্মীদের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নতুন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে শেখানো এবং তাদের কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। ৫. যুদ্ধ পরিচালনা ও প্রশিক্ষণÑ সামরিক ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র চালনা, নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি ভার্চুয়াল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে।
৬. প্রদর্শনীÑ জাদুঘরে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রয়োগের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের জন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করা খুবই সহজ হয়। ৭. কোয়ালিটি কন্ট্রোলÑ প্রোডাকশনের গুণগতমান যাচাই-বাছাই করার জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ৮. গবেষণাÑ নকশা, প্রকৌশল, বিপণন ইত্যাদি নানা ধরনের গবেষণার কাজে সিমুলেশনের মাধ্যমে কম্পিউটারের থ্রিডি ইমেজ ব্যবহার করা যায়।
৯. মহাকাশ যাত্রাÑ নভোচারীদের ভার্চুয়াল পরিবেশে মহাকাশে অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানে সহায়ক। ১০. ভার্চুয়াল মিটিংÑ অনলাইন যোগাযোগ, যা বিভিন্ন ভৌত অবস্থানের লোকদের একই ভার্চুয়াল রুমে মিলিত হতে তাদের মোবাইল বা ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইস ব্যবহার করতে সক্ষম করে। বিগত করোনাকালে বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে সংযুক্ত ছিল ভার্চুয়াল রিয়েলিটির এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষের জীবনে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে। এগুলো হলোÑ ১. বাচ্চারা গেমসের ওপর দিন দিন আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির ক্ষতি হতে পারে। এমনকি কর্নিয়াও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ইষঁব যিধষব নামে এক ধরনের গেমস সফটওয়্যার মানুষের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। অনেক ছেলেমেয়ে এই গেমের নেশায় পড়ে জীবন দিয়েছে পর্যন্ত। ২. কল্পনা জগতের প্রতি মানুষ বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে।
সেজন্য সমাজে মনুষ্যত্বহীনতার (উবযঁসধহরুধঃরড়হ) মতো বিষয়গুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইচ্ছামতো কল্পনার জগতে বিচরণের সুযোগ লাভের ফলে মানুষ বাস্তবতার অনুভূতি সম্পর্কে উদাসীন থাকছে। ৩. একে অপরের মাঝে পারস্পরিক ইন্টারেকশনের অভাবে সমাজে অনিশ্চয়তা বিরাজ করতে পারে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ইতিহাস দেড়শ’ বছরের বেশি। শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি কবি ও নাট্যকার অ্যান্টনিম আরচিউড তার লেখা ‘ঞযব ঞযবধঃৎব ধহফ উড়ঁনষব’ ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে। এরপর আঠারো শতকে ত্রিশের দশকে স্টেরিওস্কোপ আবিষ্কারকালে ইমেজ প্রোজেক্ট করার জন্য একটি টুইন মিরর (ঞরিহ সরৎৎড়ৎ) ব্যবহার করা হয়, যেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়াও ডেমিয়েন ব্রডরিকের ‘ঞযবফ ঔঁফধং গধহফধষধ’ নামক সায়েন্স ফিকশনেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৬১ সালে গড়ৎঃড়হ ঐবরষরম সেন্সোরমা সেমুলেটর নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বাস্তব উপায়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি উপস্থাপন করলেও, সেখানে কোনো প্রকার কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়নি।
পরবর্তীতে মরটন হেইলিং গড়ৎঃড়হ ঐবরষরম কর্তৃক ১৯৫৭ সালে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কারিগরি উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। অবশ্য ১৯৮০ দশকের মধ্যভাগে জারন জেনিয়ার (ঔধৎড়হ ষধহরবৎ) সর্বপ্রথম একে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নামকরণ করেন। পরবর্তীতে ভিজুয়াল প্রোগ্রাম ল্যাব (ঠচখ) এর প্রতিষ্ঠাতা হ্যাকার লেনিয়ার ১৯৮৪ সাল থেকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়