ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

ফয়সাল বিন লতিফ

অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৬ অক্টোবর ২০২৪

অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব

অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব

প্রবাস মানে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস। প্রবাস মানে মা-বাবা ভাইবোন আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী ছেড়ে নিঃসঙ্গ একাকী জীবনযাপন। প্রবাস মানে এক বুক দীর্ঘশ্বাস। প্রবাসে এসে কেউ চাকরি করে কেউবা করে ব্যবসা। দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। প্রবাসীর স্বপ্ন ভালো আয়-রোজগার করে পরিবারকে সচ্ছল করে স্বাবলম্বী হওয়া। সে স্বপ্ন নিয়েই দূর প্রবাসে আসা। প্রবাসে বেশিরভাগ মানুষ শ্রমিক অর্থাৎ, শতকরা ৯৫ ভাগ শ্রমজীবী, বাকি ৫ ভাগ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যবসায়ী।

প্রবাস জীবন যারা কাটিয়েছেন একমাত্র তারাই জানেন প্রবাসীদের দুরবস্থার কথা। প্রবাসীদের স্বপ্ন স্বপ্নই, বাস্তবতা কিন্তু অন্য রূপ। বাংলাদেশের মতো প্রবাসে ছুটি নেই বললেই চলে। বছরে শুধু ঈদ ও কোরবানিতে দুই থেকে তিন দিন ছুটি। ছুটিতে যেদিন দেশে ফিরবে সেদিনই প্রবাসীদের সবচেয়ে খুশির দিন। ছুটিতে দেশে এলে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা মনে করে অনেক টাকা ব্যাংকে জমা আছে, কিন্তু খরচ করছে না। একজন প্রবাসী তার সাধ-আহ্লাদ জীবন-যৌবন মা-বাবার স্নেহ-আদর বাচ্চাদের ভালোবাসা সবকিছু ত্যাগ করে শুধু পরিবারের জন্য, দেশের জন্য।

দেশের কাছে প্রবাসীরা রেমিটেন্স যোদ্ধা, অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু দেশ সেই প্রবাসীদের কী সুবিধা দিয়েছে? জন্ম নিবন্ধন, ভোটার আইডি কার্ড, জমি বেচাকেনা, স্কুল-কলেজে বাচ্চাদের ভর্তির ব্যাপার বলুন কোনো জায়গায় প্রবাসীদের অগ্রাধিকার নেই। একজন প্রবাসী কলুর বলদের মতো খাটে। সে যদি চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসে তার খবর কেউ রাখে না। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদের কাছেও নিগৃহীত হতে হয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এই হতভাগা প্রবাসীরা স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র স্বাদ পায়নি।

প্রবাসীরা তাদের ঘাম ঝরানো রেমিট্যান্স মাস শেষ হওয়ামাত্রই বাংলাদেশে প্রেরণ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলো দারিদ্র্য দূর করতে পারে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পরে একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় ৮২ শতাংশ বাড়ে। রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন অধিকাংশ গ্রামে বসবাস করেন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকা-ে গতিশীলতা বাড়ছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যার মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের মতো। অভিবাসীদের বড় অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। যে ১০টি দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য। এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ আসে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশের রিজার্ভ দিনকে দিন শক্তিশালী হলেও বাজেটে তাদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ থাকে না। নগদ প্রণোদনা ছাড়া বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য নামেমাত্র যেই বাজেট আছে, তা মূলত প্রবাসীদের জন্য নয়। সেটি ব্যয় হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব খরচের খাতে। প্রবাসীদের সরাসরি উন্নয়ন খাতে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ থাকে না। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ধরে রেখেছে।

সব প্রবাসীর আয়-রোজগার এক নয়; তবে বেশিরভাগ প্রবাসীর জীবন এইরকম। সমাজের এদিক ওদিক তাকালে দেখতে পাবেন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদান প্রবাসীদের রয়েছে অনেক অবদান। তাই প্রবাসীদের প্রতি পরিবারের ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। তাদের যৌক্তিক দাবি পূরণে আগ্রহী এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রবাসীদের দাবিসমূহ দেশ ও জাতির স্বার্থে পূরণ করা প্রয়োজন।
০১. জন্ম নিবন্ধন ও ভোটার আইডি কার্ডসহ অন্যান্য ডকুমেন্টসের সংশোধনের জন্য দূতাবাসে বিশেষ সেল চালু করা।
০২. প্রবাসীদের মৃতদেহ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ফ্রিতে প্রেরণের ব্যবস্থা করা।
০৩. সকল প্রবাসীর রেমিট্যান্স প্রেরণের ওপর ভিত্তি করে প্রবাসী পেনশন স্কিম চালু করা।
০৪. প্রবাসীর স্বাস্থ্যবীমা (মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স) নিশ্চিত করে প্রবাসে এবং দেশে স্বল্প খরচে ভালোমানের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
০৫. দেশে সরকারিভাবে প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় প্রবাসী হাসপাতাল করার দাবি জানাই। যেন প্রবাসী পরিবার স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন।
০৬. প্রবাস থেকে দেশে ফেরত কর্মীদের স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
০৭. নারী কর্মীদের বিদেশে প্রেরণের জন্য এজেন্সিগুলো নির্ধারিত বয়স ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
০৮. প্রবাসে অসহায় নারী শ্রমিকদের জন্য দূতাবাসের আশ্রয় কেন্দ্রে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে, তাদের অল্প সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
০৯. প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে দূতাবাসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করা।
১০. প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য দূতাবাসের আইনি পরামর্শ ও সহায়তা কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা।
১১. পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য আগের মতো কনস্যুলেট সেবা চালু করা। প্রবাসী সেবা কেন্দ্রগুলোর সেবার মান বাড়ানোর ব্যাপারে দূতাবাসের অফিসারদের দিয়ে দৈনিক মনিটরিং করা।
১২. প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার জন্য দূতাবাস কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি বাংলা স্কুল চালু রাখা।
১৩. বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রবাসীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা।
১৪. এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের সঙ্গে যথাযথ সম্মানপূর্বক কথা বলা, প্রবাসী কল্যাণ ডেক্সকে শক্তিশালী করা। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তারা এয়ারপোর্টের নিয়ন্ত্রণ এবং যেখানে প্রবাসীদের সমস্যা হবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা।
১৫. প্রবাসী কল্যাণ ডেক্সের মাধ্যমে বিশেষ সেল চালু করে তাদের লাগেজ গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
১৬. যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দেশে টাকা প্রেরণ করেন, তাদের দেশে অবস্থানকালে পুলিশ প্রটোকলের ব্যবস্থা করা।
প্রবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দাবি-দাওয়া সঠিকভাবে যদি পূরণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রবাসীদের অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে তাদের পরিবারগুলো বাজার কাঠামোতে অর্থ বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি মাস সমূহের রেমিট্যান্স প্রবাহ তারই প্রমাণ।

প্রবাসীরা হলো দেশের মোহর। যে মোহরের কারণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দেশ। তাই সরকারের উচিত প্রবাসীদের ভালো রাখার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বর্তমানে দেশের সংকটময় মুহূর্তে থেকে উত্তোরণের জন্য প্রবাসীদের দাবি বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। নির্দ্বিধায় বলতে পারিÑ দেশের জন্য দশের জন্য পরিবারের জন্য একজন প্রবাসী একজন সৈনিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

    লেখক :  ব্যাংক কর্মকর্তা

×