ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৬ অক্টোবর ২০২৪

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন

বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্নীতির কবলে পড়েছে

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্নীতির কবলে পড়েছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক সততা ক্ষুণœ হয়েছে এবং জনগণের বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে- যাদের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে। এই ব্যাপক সমস্যাগুলোর মধ্যে আর্থিক লেনদেন, দুর্নীতি প্রক্রিয়া, দরপত্রের কারসাজি বা টেন্ডারবাজি এবং তহবিলের সুস্পষ্ট অপব্যবহার অন্যতম।

এমতাবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতির মাত্রা বিশ্লেষণ করে দুর্নীতির উদাহরণ তুলে ধরে শিক্ষাবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন প্রয়োজন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হবে। দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার জন্য আলাদা কমিশনও প্রয়োজন। তবে অন্য কমিশন গঠিত না হলে উচ্চশিক্ষা কমিশনের কাজ সকল পর্যায়ে (প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়) বিস্তৃত করা যেতে পারে।
দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় গত কয়েক দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দুর্নীতি গভীরভাবে প্রবেশ করেছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। আর্থিক দুর্নীতি, যার মধ্যে অবৈধ লেনদেন ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি অন্তর্ভুক্ত। প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা পর্যায়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যদিও সরকারি অপরাপর প্রতিষ্ঠান (যেমন সচিবালয়, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, সড়ক নির্মাণ বা মেগা প্রকল্প) অপেক্ষা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতির অঙ্ক নগণ্য। কিন্তু জনগণের কাছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। উচ্চতর বিদ্যাকেন্দ্র বিধায় কোনোভাবে প্রত্যাশিতও নয়। 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখী দুর্নীতির চিত্র প্রায় সকলের জানা। দুই দশক পূর্বে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের কথা কখনো শোনা যায়নি। কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে তা পরবর্তীতে শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃতি পায় মূলত জবাবদিহিতা ও বিচারহীনতার কারণে। যার ফলস্বরূপ অধিকাংশ উপাচার্য নিয়ম অনুযায়ী সম্মানের সঙ্গে বিদায়ও নিতে পারেননি। খবরের কাগজে প্রকাশিত রিপোর্টসমূহে আর্থিক লেনদেনের জন্য নীতি পরিবর্তনের উদ্বেগজনক ধরন প্রকাশিত হয়েছে।

শিক্ষার্থী ও কর্মচারী নিয়োগ একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রভাষক পদের জন্য ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী পদের জন্য ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়। এ সম্পর্কিত অডিও প্রকাশিত হয়েছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিবাদ-সমাবেশও হয়েছে। এই একাডেমিক নিয়োগের বাণিজ্যিকীকরণ উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখার পক্ষে প্রয়োজনীয় বিধি ও নীতিমালাকে বিপন্ন করেছে মারাত্মকভাবে। 

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, আর্থিক লেনদেন, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক প্রীতি, পছন্দের প্রার্থীর নিয়োগের জন্য প্রচলিত নীতিমালা স্থগিত বা পরিবর্তন, পদোন্নতিতে অনিয়ম, পদোন্নতি প্রলম্বিত করা ইত্যাদি অন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই অপকর্মগুলো গত দুই দশকের জাতীয় খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছে বারবার। বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির প্রতিরোধের মুখে শিক্ষক পদের জন্য পছন্দমতো প্রার্থীদের উপাচার্যের বাসভবনে নিয়ে গিয়ে সাক্ষাৎকারের মতো ঘটনাও ঘটেছে, যা প্রচলিত নিয়মনীতি ও অনুশীলনের সকল মাত্রাকে অতিক্রম করেছে এবং এই নিয়োগের সততার বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। আর্থিক খাতের অপব্যবহার নিয়োগের অসংগতিকেও ছাড়িয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একটি ফ্যাকাল্টি ভবনের উদ্বোধনেই ৪৪ লাখ টাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে একটি একবেলার স্থানীয় সেমিনারে ১৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই বিশাল খরচ এবং ভর্তি পরীক্ষার খরচের অপর্যাপ্ত হিসাব, আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির একটি উদ্বেগজনক ধরন প্রকাশ করে। আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি কম-বেশি প্রযোজ্য। খবরের কাগজের মাধ্যমে দেশবাসী মোটামুটি তা অবগত। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো জানেই। 
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসি দুর্নীতির সমস্যাগুলো মোকাবিলায় অভিযুক্ত উপাচার্যদের তদন্ত করার জন্য অনুসন্ধানী কমিটি গঠন করেছে। তবে এই অনুসন্ধানগুলোর কার্যকারিতা গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। কিছু তদন্ত পরিচালিত হলেও প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর পদক্ষেপে গাফিলতি দেখা গেছে। দুর্নীতি ও নীতিবহির্ভূত নিয়োগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তার উদাহরণ মাত্র। এই অপচিত্র বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া অসংশোধনমূলক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপের অভাব দুর্নীতির প্রতি কেবলমাত্র সহনশীলতা নয়, বরং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে বিস্তার ঘটায়। যখন ক্ষমতা ও দায়িত্বের উঁচু অবস্থানে থাকা কর্তাব্যক্তিরা তাদের অসদাচরণের জন্য পরিণতি এড়াতে সক্ষম হয়, তখন তা সংকটকে আরও তীব্র করে এবং উচ্চশিক্ষা খাতে নিয়মনীতি ও সততা পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বর্তমান সমস্যাগুলো এবং বিদ্যমান তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা থেকে অপ্রতুল সাড়া ও প্রতিক্রিয়া উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যাপক সংস্কারের তীব্র প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাফল্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জনগণের একটি কাক্সিক্ষত চাহিদা নির্দেশ করে। এই গতি বজায় রাখতে এবং দুর্নীতি মোকাবিলা করতে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন তাই অপরিহার্য। প্রস্তাবিত কমিশনের সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ :
১. পূর্ণাঙ্গ সংস্কার : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, উপাচার্য নিয়োগ, ছাত্র সংসদ ও সিনেট নির্বাচন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, মুক্তমনা অনুশীলন, নিরাপদ ও সর্বোপরি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির বাধাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।   
২. নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়বদ্ধতা : কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, যেমন আর্থিক দুর্নীতি, পেশাগত অসদাচরণ, নিয়োগের অসংগতি এবং তহবিলের অপব্যবহার নিয়ে গভীর তদন্ত পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। সংশ্লিষ্টদের তাদের কার্যকলাপের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে কমিশন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় পুনরায় বিশ্বাস স্থাপন করতে সহায়তা করবে।
৩. বিস্তৃত শ্বেতপত্র প্রকাশ : কমিশনের তদন্তের ফলাফলগুলো বিস্তারিতভাবে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত, যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতির স্বচ্ছ বিবরণ প্রদান করবে। এই নথিটি নীতিনির্ধারক, একাডেমিক নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে কাজ করবে, যা সঠিক আলোচনা এবং ভবিষ্যৎ সংস্কারের পথনির্দেশ করবে।
৪. জনগণের বিশ্বাস পুনঃস্থাপন : বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে একাডেমিক সম্প্রদায়ের প্রতি জনগণের বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করা যায়। যদিও বেশিরভাগ শিক্ষক এবং কর্মচারী দুর্নীতিতে জড়িত নন, কিন্তু পুরো সম্প্রদায়ের সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্তদের অপকর্মের সংযুক্তি তাদেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার প্রতি প্রতিশ্রুতি একাডেমিক পেশার ইতিবাচক চিত্র পুনঃস্থাপনে সহায়ক হবে। 
৫. ভবিষ্যৎ দুর্নীতি প্রতিরোধ : কমিশনকে ভবিষ্যতের দুর্নীতি কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। এর মধ্যে নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রণয়ন, আর্থিক তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে নৈতিক আচরণের সংস্কৃতি প্রচার-প্রসার অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকল প্রকার দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে এবং কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অন্তত গত দুই দশককে বিবেচনা করতে হবে। একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা এবং উচ্চশিক্ষা খাতে সততা পুনঃস্থাপন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। নীতিনির্ধারক, একাডেমিক নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণকে এই উদ্যোগকে সমর্থন করতে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সমর্থন জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে, আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা বজায় রেখে এবং নৈতিক কার্যকলাপ প্রচার করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সততার কেন্দ্র হিসেবে পুনর্গঠন করতে হবে। 
পূর্বেকার উপাচার্য ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি ও নিয়মবহির্ভূত কর্মকা-ের তদন্ত সাপেক্ষে বিচার নিশ্চিত করা না হলে এই ধারা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলে ন্যায় ও নিয়মের পথে থাকতে অনুপ্রেরণা পাবেন এবং সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে সচেষ্ট থাকবেন। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের সম্মান সমুন্নত থাকবে। 
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের সম্মিলিত ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়নে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন প্রতিষ্ঠা শুধু সমাধান নয়, এটি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ সততা রক্ষা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতাও। প্রয়োজনে এই কমিশনের কর্মপরিধি উচ্চশিক্ষা ছাড়াও সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় বিস্তৃত করা যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×