ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাধীনতা ও মুক্তি

ড. মো. আবু তাহের

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৫ অক্টোবর ২০২৪

স্বাধীনতা ও মুক্তি

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পর অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি নিয়ে নাগরিক সমাজ বেশ উদ্বিগ্ন। অনেকেই খোলামেলাভাবে প্রশ্ন তুলেছেন, পরিবর্তিত বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে? বর্ণিত বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়ার নিমিত্তে আজকের নিবন্ধের অবতারণা।
‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দুটোই স্বতন্ত্র এবং এর পৃথক সত্তা রয়েছে। স্বাধীনতা একটা পিরিয়ডিক্যাল বিষয়। আর মুক্তি নন-পিরিয়ডিক্যাল। স্বাধীনতার সংগ্রাম এক পর্যায়ে শেষ হয়। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম চলমান থাকে। 
১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আমরা পেয়েছি আমাদের ঠিকানা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা। রচিত হয়েছিল সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংবিধান। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা উত্তর প্রতিটি সরকার নিজেদের স্বার্থে উক্ত সংবিধানকে অন্তত ১৭ বার ক্ষত-বিক্ষত করেছে।

দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংবিধান পুনর্লিখন কিংবা সংস্কার নিয়ে অংশীজনদের  মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা চলমান রয়েছে। যেহেতু আমি মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ; আইন কিংবা সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই, সেহেতু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না করাই শ্রেয় মনে করি। 
অনেকে এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশ-২ বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, স্বাধীনতা একবারই হয়। এরপর যেগুলো হয়ে থাকে ‘স্বাধীনতা’ না বলে ‘মুক্তি’ বলাই শ্রেয়। কেননা, স্বাধীনতার সংগ্রাম বারবার হয় না। তবে মুক্তির সংগ্রাম চলতেই থাকে অনন্তকাল। 
জীবনে পথ চলায় আমরা কোনো না কোনোভাবেই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি। এমনকি অনেক সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। উক্ত সমস্যা সমাধান কিংবা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ক্রমাগতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। ইউরোপসহ পৃথিবীর উন্নত দেশে বর্তমানে যে জ্ঞানভিত্তিক-মানবিক সমাজ ও সভ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা একদিনে হয়নি। বরং বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এ সাফল্য এসেছে। আমাদেরও নিঃশঙ্কচিত্তে সকল ধরনের বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে সাফল্য তথা মুক্তির জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে।
রবীন্দ্রনাথ একটি লেখায় লিখেছেন, তার ছোট্ট মেয়েটি হামাগুড়ি দিয়ে মেঝের ওপর একটা আরশোলা দেখে ওটাকে ধরার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু একটানা এগিয়ে যাচ্ছে না। যতক্ষণ আরশোলাটা চলছে, ততক্ষণ সে চলছে। কিন্তু আরশোলাটা থেমে পড়লে সেও থেমে যাচ্ছে। আরশোলা আবার চলতে শুরু করলে, সেও আবার চলতে শুরু করছে দেখে কবিগুরুর মনে হলো, এই হলো বিশ্বের গতি, এর চলমানতার ছন্দ। এটা একটানা চলে না, চলে থেমে- এগিয়ে, থেমে-এগিয়ে। 
৪০-এর দশক থেকে বাংলাদেশ অব্দি বহু আন্দোলন-সংগ্রাম-গণঅভ্যুত্থান-মুক্তিযুদ্ধ-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-ক্ষমতার পালাবদল মানুষ দেখেছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও বহু মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। এমনকি আমার জীবনে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-ক্ষমতার পালাবদল দেখেছি। কৈশোর বয়সে প্রত্যক্ষ করেছি স্বাধীনতা সংগ্রাম। যৌবনে এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি।

১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান দেখেছি, ১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেখেছি এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার  পতনের এক দফার আন্দোলনও প্রত্যক্ষ করেছি।  প্রতিবারই নিত্যনতুন স্লোগান এসেছে, প্রতিবারই ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়। এভাবে ভেঙে ভেঙেই আমরা ক্রমাগত এগিয়েছি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তীতে ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উক্ত সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত  ভাষণে  বলেছেন, ‘আমরা সকলে একটি পরিবার। সকলকেই দেশ ও জাতির কল্যাণে একযোগে কাজ করতে হবে। কেউ অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। হিংসা- প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না।.... আপনাদের অনেক দুঃখ-কষ্ট জমা আছে - সেটা আমরা বুঝি।

আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ লাঘবের সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন।’ ‘রাষ্ট্র সংস্কার’সহ গণমানুষের কল্যাণে ভাষণটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা আশা করি, সামনের দিনগুলোতে গৃহীত রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক- গণতান্ত্রিক-জ্ঞানভিত্তিক-সহনশীল-মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন-ন্যায়ভিত্তিক- বৈষম্যহীন সমাজ  বিনির্মাণ করতে আমরা সক্ষম হব অবশ্যই। 
‘আমার এ দেশ সব মানুষের’- এই স্লোগানকে ধারণ করে হিংসা- প্রতিহিংসা- বিদ্বেষ পরিহার করে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর বুকে বৈষম্যহীন-উন্নত-সমৃদ্ধ- ন্যায্যভিত্তিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হবে -এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। 

লেখক : অধ্যাপক, সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×