আরিফ বিল্লাহ মিঠু
শুক্রবারের দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় পাতার ‘প্রসঙ্গ ইসলাম’ শিরোনামের কলামে দৃষ্টি রাখলে অগণিত পাঠকের ন্যায় আমারও মানসপটে ভেসে ওঠে তোমার নাম, তোমার শশ্রুম-িত নূরানী মুখায়ব। যার কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, আমার জন্মদাতা পিতা। আব্বা হুজুর আলহাজ শাহ সুফী আবুল হাসান মুহম্মদ আবদুল কাইয়ূম (সংক্ষেপে অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম)। অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম সমকালীন বাংলাদেশের আলেম সমাজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইলমে তাসাওইফ চর্চাকারীদের পথ প্রদর্শক, আদর্শ শিক্ষক ও ওস্তাদ।
আমার আব্বা হুজুর ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর দুরারোগ্য ব্যাধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি অসংখ্যা ভক্ত-অনুরাগী, মুরিদ ও শুভাকাক্সক্ষীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। তার মৃত্যুর চার বছর পরও অসংখ্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেম, রসূল প্রেমিক পাঠক ও ভক্তবৃন্দ তার অভাব অনুভব করেন। বিশেষ করে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মাস আসলে তার কথা আরও বেশি মনে পড়ে।
তার মতো রাসূল (সা.)-এর শান, মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে মিলাদ কিয়ামের সপক্ষে জোরালো কণ্ঠে কথা বলার মতো আশেকে রসূলদের আজ বড় অভাব। আলেম সমাজ আজ বড়ই দ্বিধা বিভক্ত। অথচ নিজেদের সুসংগঠিত করে ইসলামের সৈন্দর্যকে বিকশিত করা এখন বেশি প্রয়োজন।
আমার আব্বা হুজুর আজ থেকে ৭৬ বছর আগে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন দ্বারিয়াপুরের সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় ভাই শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। শৈশবে তার হাতেখড়ি বিদুষী মাতা মোছাম্মাৎ জহরা খাতুনের কাছে। পরবর্তীতে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু হয়ে দেশের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শেষ করেন।
প্রথমে অধ্যাপক হিসেবে শুরু করেন। পরবর্তীতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে অত্যন্ত দক্ষতা ও সম্মানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে চাকরি জীবন শেষ করেন। তার আব্বা হুজুর ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান (রহ.)-এর অন্যতম প্রধান ও সর্বকনিষ্ঠ খলিফা নায়েবে মুজাদ্দিদে যামান আলহাজ শাহ সুফী মাওলানা তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ.)। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার ক্ষুরধার লেখনী, আনলবর্ষী বক্তৃতা, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পাঠক, শ্রোতাকে সহজেই আকৃষ্ট করত, মানুষ উপকৃত হতো।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে পাঠক হৃদয়ে চির অমর হয়ে আছেন। গবেষকরা তার লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। আল্লাজাল্লা শানুহু কথাটি এদেশে তিনিই প্রথম প্রচলন করেন তার লেখনী ও আলোচনায়। তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর অনুপম আদর্শ নামে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ লিখেছেন। এ ছাড়া ফুরফুরা চাঁদ, ইসলাম ও জীবনসহ বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও অনুবাদ গ্রন্থের ওপর কাজ করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত অবস্থায়।
তার সম্পর্কে অনেক কথা বলা ও লেখা যায় কিন্তু যাদের জন্য তিনি কাজ করেছেন তাদেরই তার মূল্যায়নে এগিয়ে আসতে হবে, নতুবা বর্তমান আলেম সমাজও এক সময় হারিয়ে যাবে। কথায় আছে- যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। তাই এই বিশেষ দিনে তার প্রতি শুদ্ধা, ভালোবাসা ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বলতে চাই, ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ / তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়ে যায় কীর্তিরে তোমার বারংবার/চিহ্ন তব পড়ে আছে তুমি হেথা নেই।’ আমীন।
লেখক : অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূমের ছেলে, দ্বারিয়াপুর শরীফের বর্তমান গদ্দিনশীন পীর