ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৪: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন অপরিহার্য

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ৫ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৪: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন অপরিহার্য

প্রতীকী ছবি। 

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৪-এর প্রাক্কালে, যখন আমরা শিক্ষকদের অমূল্য অবদান উদযাপন করছি, তখন আমি কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে চাই যা শিক্ষার ও জাতির উন্নয়নের জন্য ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে। 

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একটি শিক্ষামূলক পরিবেশের ভিত্তি। এটি শুধু জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন প্রদর্শন করেন, তখন তা শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কিন্তু এটি একমুখী নয়! শিক্ষার্থীদেরও উচিত শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা। এই সম্পর্ক যত বেশি মজবুত হবে, তত বেশি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। 

সাম্প্রতিক ছাত্র নেতৃত্বাধীন বৈষম্য বিরোধী মহান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, নতুন এবং ন্যায় ভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের এক অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এটি বাংলাদেশ ২.০ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এটি আমাদের সেই প্রিয় বাংলাদেশ, যার স্বপ্ন ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মাধ্যমে রোপিত হয়েছে। আমরা সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সদা প্রস্তুত ছিলাম, এবং এখন সেই লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছি, সাম্প্রতিক এ আন্দোলনে বিজয়ের মাধ্যমে। ফলে, সবার অংশগ্রহণ, টেকসই ও মানসম্পন্ন শিক্ষা, পারস্পরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা, সম্মান ও বিবেচনাপ্রসূত আচরণ আমাদের সেই গন্তবে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটছে। এর ফলে অসংখ্য শিক্ষক অবমাননা, বাধ্যতামূলক পদত্যাগ এবং জনরোষের শিকার হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি আন্দোলনের মৌলিক ভিত্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণ করছে। এই দুঃখজনক বাস্তবতা আমাদের শিক্ষকদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে যে সম্মানের ভীত রচনা হয়েছিল, তা ক্ষুণ্ণ করছে। 

বৈষম্য বিরোধী এই আন্দোলনে নিহত শত শত মহান শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি, কারণ এই দুঃখের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। পাশাপাশি, হাজার হাজার আহতের জন্য আমাদের সমবেদনা এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য অফুরন্ত দোয়া রইল। আমি এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আপনারা যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছেন, তা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নয়, বরং সমস্ত অবিচারের বিরুদ্ধে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে আপনারা ইতিহাসের পাতা নতুন করে লিখেছেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি নতুন পথ প্রদর্শন করেছেন।

এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অন্যদের মর্যাদা, সম্মান এবং মানবাধিকারের রক্ষা করা। আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা যেভাবে অসাধুতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রমাণ করেছেন, তেমনি সকল অপরাধীদের আনুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে দেওয়া আবশ্যক। আমাদের বীর যোদ্ধারা ন্যায়, শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা, এবং অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেছেন। সুতরাং, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অপরিহার্য; আমরা আইনকে উপেক্ষা করে নিজেদের হাতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারি না।  
এ এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্যান্য পেশার মতো, শিক্ষক পেশাতেও কিছু শিক্ষক আছেন যারা সমাজের প্রত্যাশিত আদর্শ অনুসরণ করেন না। তবে, আমাদের সবার কাজ হলো একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা এবং আমরা যেসব ভালো আচরণ দেখতে চাই, সেগুলোর দিকে নজর দেয়া। যখন শিক্ষকদের অবমাননা করা হয়, তখন তা কেবল অপ্রত্যাশিত নয়; বরং এটি শিক্ষার জন্য খারাপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষার ভিত্তি হলো সম্মান ও শেখার সম্পর্ক, এবং যখন এই সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়, তখন শিক্ষার গুণগত মানও কমে যায়।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমাদের শিক্ষকদেরও কিছু শেখার সুযোগ রয়েছে। তাঁরা তাঁদের ভূমিকার ওপর পুনর্বিবেচনা করতে পারেন, যাতে একটি সম্মানজনক ও সহায়ক শিক্ষামূলক পরিবেশ গড়ে তোলা যায়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে, শিক্ষকদের একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই পরিবেশটি মুক্ত আলোচনা ও পারস্পরিক সম্মানকে উৎসাহিত করবে, যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।  

অতীতে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের অবমাননার ঘটনার উদাহরণ দেখা গেছে। এই ধরনের আচরণ শুধু শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক সম্মান। যখন শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে সম্মানের সাথে মূল্যায়িত অনুভব করে, তখন তাদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীদেরও অধিকার আছে সমান মর্যাদা ও সম্মান পাওয়ার। তাদের মতামত ও অনুভূতিগুলি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। এই সম্মানের অভাবে, শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে এবং তারা তাদের শেখার প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। তাই একটি ইতিবাচক ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে, শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করা। একইভাবে, শিক্ষার্থীদেরও উচিত শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এই পারস্পরিক সম্মান শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।

নতুন বাংলাদেশ গড়ার এই মোক্ষম সময়ে সকলের মহানুভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষমা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্মানের একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব। যখন আমরা ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমরা নেতিবাচকতার চক্র ভেঙে নিজেদের এবং সকলের জন্য একটি উচ্চ মান স্থাপন করি। এই সদিচ্ছার কাজ আমাদের চারপাশের মানুষদের উজ্জীবিত করে এবং শিক্ষার যে মূল্যবোধগুলোকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তা আরও দৃঢ় করে।

এমন পরিস্থিতিতে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতভেদ থাকলে, উদ্বেগগুলোকে শ্রদ্ধার সাথে প্রকাশ করা উচিত। গঠনমূলক সংলাপ শত্রুতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। সহপাঠীদের মধ্যে ক্ষমার সংস্কৃতির প্রচারও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে, সকলের মধ্যে ত্রুটি থাকে, শিক্ষকদেরও, এবং আমরা সবাই আমাদের ভুল থেকে শিখতে এবং বাড়তে পারি।

সুতরাং, আমাদের সকলের উচিত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে আরও গভীর করা এবং একটি ইতিবাচক শিক্ষামূলক পরিবেশ গড়ে তোলা। এই পারস্পরিক সম্মান শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে,আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সম্মানজনক ও সহায়ক শিক্ষামূলক পরিবেশ গড়ে তুলি, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই মর্যাদার সাথে বাঁচতে ও শিখতে পারে।  

লেখক: মো. হাসান হাওলাদার
সহযোগী অধ্যাপক
ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected] 

এম হাসান

×