.
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। সাধারণ পরিষদ হচ্ছে সংস্থাটির প্রধান নীতিনির্ধারণী অংশ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে বিশ্বের আইন পরিষদ বলা হয়। ৭৯তম অধিবেশনের এবারের বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে, ‘কাউকে পিছিয়ে রাখা নয়; বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানব মর্যাদার অগ্রগতিতে একসঙ্গে কাজ করা’। নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে সদস্য দেশের নেতারা বৈঠকে বসে বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।
এবারের সম্মেলনের মূল আহ্বান ছিল একযোগে সহযোগিতা। কেবল সাময়িকভাবে সমস্যা সমাধান করতেই নয়, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকীকরণ করতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক হুমকির মোকাবিলা করা যায়। এবারের অধিবেশনে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা সবচেয়ে বেশিগুরুত্ব পেয়েছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গাজায় তাদের বর্বর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ হাজার ১১৮ জনে পৌঁছেছে। এছাড়া প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। লেবাননে ইসরাইলি হামলায় মৃতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য না হয়েও এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নির্যাতিত ফিলিস্তিন আসন পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করল জাতিসংঘ। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন নতুন ইতিহাস গড়ল। মূল অধিবেশনে গাজা যুদ্ধ ইস্যু ও দখলদার ইসরাইলি আগ্রাসন নিয়ে বিশ্ব দরবারে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে ফিলিস্তিনি প্রশাসন।
তবে ইসরাইলের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ফিলিস্তিনকে সদস্যরাষ্ট্রের আসনে বসতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ২০১২ সালে পর্যবেক্ষক হিসেবে জাতিসংঘে প্রবেশের অনুমতি পায় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যেন বিশ্ব নেতাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল গাজা-ইসরাইল-লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু। গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে গত এক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত চরমে পৌঁছেছে। গাজা-ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ গত এক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হুতি বিদ্রোহীদের ছায়া যুদ্ধে প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাণিজ্যে। সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের মহাসচিবকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেও অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আলোচনা সীমাবদ্ধ সংকটেই। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গটি বারবারই উঠে আসছে। এই অধিবেশনে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার দে ক্রু বলেন, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের সমাধান সামরিক হস্তক্ষেপে কখনোই সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুপক্ষ আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অক্টোবর না হয় ইসরাইল নিজেকে রক্ষা করেছিল।
এখন কি করছে? ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। কোনো সামরিক শক্তি এই সংঘাতের ইতি টানতে পারবে না। এ সময় মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অধিবেশনের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈরুতে যে সহিংসতা ইসরাইল শুরু করেছে, স্পষ্ট বোঝা যায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতেই এই উদ্যোগ। বিশ্বের জন্য যা ধ্বংসাত্মক। ইসরাইলের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানাই। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। দ্বিরাষ্ট্রনীতি একমাত্র সমাধান।’
ইরানের প্রেসডিন্টে মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, গাজা ও লেবাননে বর্বরোচিত অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে ইসরাইলি প্রশাসনের আসল চেহারা বিশ্ব দেখছে। তিনি আরও বলেন, এক বছর ধরে ইসরাইলের আসল চেহারা দেখছে বিশ্ব। এই অঞ্চলে ঠান্ডা মাথায় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরাইল। যা গণহত্যার শামিল। সমগ্র বিশ্বে বিক্ষোভ হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। ইসরাইল আমাদের বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে, কূটনীতিকদের হত্যা করেছে। ইসরাইলের বিরোধিতা আমরা সবসময় করে আসছি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, গাজা ইস্যুতে কোনোভাবেই শান্ত থাকতে পারে না জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। এই সংকট সমাধানে ব্যর্থতা জাতিসংঘের জন্য কলঙ্ক বলে কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি উল্লেখ করেন। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশে^ গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি, বিধ্বস্ত জনপদে নির্বিঘেœ মানবিক সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
গাজার জনগণের প্রতি স্পেনের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এ সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি ঘটানোর আহ্বানও জানানো হয়। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে গাজা যুদ্ধে ইসরাইলকে অব্যাহত সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় ইসরাইলি হামলার পর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাহমুদ আব্বাস ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের পাগলামি চলতে পারে না। আমাদের জনগণের সঙ্গে যা ঘটছে তার জন্য সমগ্র বিশ^ দায়ী। তিনি বলেন, গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকা সত্ত্বেও তারা ইসরাইলকে কূটনৈতিক সমর্থন এবং অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে বারবার ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ করেন। ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুঃখিত যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি পালনের দাবি জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের তিনবার খসড়া প্রস্তাবে বাধা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একা দাঁড়িয়ে বলেছে, না, লড়াই চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও ইসরাইলকে কূটনৈতিক সুরক্ষা ও অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। গাজা যুদ্ধ পরবর্তী ১২ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেছেন। গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইল সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে (পিএ) গাজা শাসনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশে^র বিভিন্ন দেশের নেতাদের এই বলে সতর্ক করেছেন যে, বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি ‘অস্থির’ এবং বিশ্বে দায়মুক্তির মাত্রা ‘অসহনীয়’। তিনি বলেন, কিভাবে শেষ হবে তার কোনো ধারণা ছাড়াই যুদ্ধগুলো জোরদার হচ্ছে এবং পারমাণবিক অবস্থান ও নতুন অস্ত্রগুলো এর ওপর একটি অন্ধকার ছায়া ফেলছে। আমরা অকল্পনীয় এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। একটি অস্থির পরিস্থিতি, যা সারা বিশ্বকে গ্রাস করার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, কিছু নেতা জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনকে এই বলে পদদলিত করছেন যে, তারা নিজেদের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ‘এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার’ যোগ্য বলে মনে করছেন।
তিনি ইউক্রেনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি গাজার লড়াইকে তিনি ‘অন্তহীন দুঃস্বপ্ন’ বলে অভিহিত করে এটি পুরো অঞ্চলকে প্রভাবিত করার হুমকির সৃষ্টি করেছে বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়া, তিনি লেবানন এবং ইসরাইলি বাহিনী ও হিজবুল্লাহ মধ্যে লড়াইয়ের দিকেও ইঙ্গিত করেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ইসরাইল যাতে অবিলম্বে বিমান হামলা বন্ধ করে, সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের জন্য কাজ করতে হবে। ইসরাইলের চালানো হামলায় নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, তাই এর জবাব দিতেই হবে। তিনি আরও বলেন, এই হামলার পরিণতির দায় সেই সরকারগুলোর ওপরই বর্তায় যারা মর্মান্তিক এই পরিস্থিতি সমাপ্ত করার লক্ষ্যে নেওয়া আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে উভয়পক্ষকে কূটনৈতিক সমাধানের পথে আসার জন্য ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বনেতারা আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে, জাতিসংঘকে ‘অন্ধকারের ঘর’ বলে অভিহিত করেন। তিনি ইসরাইলকে অন্য দেশের মতো সমানভাবে দেখার কথা বলেন। তিনি জাতিসংঘ প্রসঙ্গে বলেন, এই ইহুদিবিদ্বেষী পিত্তে ভরা জলাভূমিতে অধিকাংশই ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি অমানবিক। গত দশকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অনেক প্রস্তাব পাস হয়েছে। তিনি একে ভ-ামি, দ্বিমুখী নীতি ও রসিকতা বলে মন্তব্য করেন। যুদ্ধাপরাধীরা ইরান, গাজা, সিরিয়া ও লেবাননে রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যখন আমাদের লোকজনকে হত্যা করা হয়, তখন আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য কেউ একটা আঙুল তোলে না। এখন আমাদের নিজেদের রাষ্ট্র আছে আর আমরা তা নিজেরা প্রতিরক্ষা দিচ্ছি। ইসরাইল এ যুদ্ধে জিতবে, কারণ আমাদের আর কোনো পথ নেই। তাঁর বক্তব্যে তিনি ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলাকে ইহুদি নিধনের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি হামাসের হাতে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে লেবাননে যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
হিজবুল্লাহর হামলা থেকে ইহুদি বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তিরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ না হচ্ছেন ততক্ষণ ইসরাইল বিশ্রাম নেবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। গাজা যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা গাজায় পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি না। আমরা সেখানে নিরস্ত্রীকরণ এবং উগ্রবাদমুক্ত এলাকা চাই। ইসরাইল সরকার সেখানে আঞ্চলিক ও অন্য নেতাদের আঞ্চলিক বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। তবে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখাতে হবে। কিন্তু ইসরাইল কখনো হামাসকে মেনে নেবে না। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে নেতানিয়াহু লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে চলমান সহিংসতার জন্য ইরানকে দায়ী করেন। লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস এবং ইয়েনের হুতিদেরকে ইরানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি তাদের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারক প্রভাবের প্রমাণ।
অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি দুটি মানচিত্র দেখান। মানচিত্র দুটির কোথাও ফিলিস্তিন ছিল না। একটি মানচিত্রে সবুজ রঙদিয়ে কিছু দেশকে ‘আশীর্বাদ’ এবং আরেকটি মানচিত্রে কিছু দেশকে কালো রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে ‘অভিশাপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তার ডান হাতে থাকা মানচিত্রে কালো রঙে চিহ্নিত অভিশপ্ত দেশগুলো ছিল ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন অর্থাৎ এই দেশগুলো ইসরাইলের জন্য হুমকি। আর বাম হাতে থাকা মানচিত্রে সবুজ চিত্রিত আশীর্বাদ এর দেশগুলো ছিল মিসর, সৌদি আরব ও সুদান এমনকি ভারতও। অর্থাৎ এই দেশগুলো ইসরাইলের জন্য হুমকি নয়। তিনি বলেন, বিশেষ করে লেবানন ও গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান ইরানের আগ্রাসনের জবাব।
যত দিন হিজবুল্লাহ যুদ্ধের পথ বেছে নেবে, ততদিন ইসরাইলের এই হুমকি দূর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে ইরানকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইরানের যেকোনো স্থানে হামলা করতে ইসরাইল সক্ষম। হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত তিনি লড়াই করার কথা বলেন। তিনি হামাসকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। ইরানকে হুমকি দিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ইরান যদি হামলা করে, তবে ইসরাইল পাল্টা হামলা করবে। তিনি জাতিসংঘকে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইসরাইল কখনো ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেবে না। তিনি হামাস ও হিজবুল্লাহকে পরাজিত করার কথা বলেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, নেতানিয়াহু বক্তব্য দিতে গেলে প্রথমে তুরস্কের স্থায়ী দূত অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াক আউট করেন। এর পর একে একে তাঁর পেছনে অন্য অনেকে বের হয়ে যেতে থাকেন। আরব বিশে^র প্রতিনিধিরাও নেতানিয়াহুর বক্তব্য বর্জন করে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন।
জর্দানের পরাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, নেতানিয়াহুকে থামাতে হবে। কারণ তিনি গোটা অঞ্চলকে প্রকাশ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, ইসরাইলে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আমরা এখন সবই ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু নেতানিয়াহু বিপদ সৃষ্টি করছেন। কারণ তিনি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান চান না। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেন, লেবানন আজ এমন এক শত্রু পক্ষের শিকার হয়েছে, যারা ইলেকট্রনিক, সাইবার, সমুদ্র, বিমান ও স্থলভাগে হামলা চালাচ্ছে। সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিবেশ সৃষ্টি করছে। লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তায় ইসরাইলের আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতারা আহ্বান জানিয়েছেন। চলমান যুদ্ধ বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জাতিসংঘের মহাসচিব মন্তব্য করেছেন।
এছাড়া, যুদ্ধ ও জাতিগত সংঘাতে সুদান, মিয়ানমারসহ বেশ কিছু দেশ মানবিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, ফিলিস্তিন সমস্যা মানব বিবেকে সবচেয়ে বড় ক্ষত। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, গাজার সংকট সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এখন লেবাননও একই অবস্থার দিকে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এসব সংঘাত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবনকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের বর্তমান যে বাস্তবতা তা শুধু আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই শঙ্কা ও উদ্বেগের। তাই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই ও স্থায়ী শান্তি আনতে পারে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়