.
ইসরাইলে ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং লেবাননে ইসরাইলের বিমান হামলায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। তেহরান বলেছে, ইসরাইল আবার হামলা করলে পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক। ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের সশস্ত্র হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইতিহাসের পাঠ নিলে আমরা জানব, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামলা চালিয়ে সহস্রাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও আড়াইশ’র মতো মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে আসেন হামাস যোদ্ধারা। এর জবাবে ওই দিন থেকেই গাজায় হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইল। হামাসকে নির্মূল করার অভিযানের কথা বলে ইসরাইলি বাহিনী এক বছর ধরে সেখানে নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে সেখানে স্থল অভিযানও চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। তাদের হামলায় ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল একমাত্র অ-আরব দেশ। এই অঞ্চলে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে ইসরাইলের স্বীকৃতিও সীমিত। আরব দেশগুলোর মধ্যে ১৯৭৯ সালে মিশর, ১৯৯৪ সালে জর্দান, ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিরোধের কারণে আরব-মুসলিম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসরাইলকে দখলদার এবং আগ্রাসী হিসেবে দেখে। গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধ এই অবস্থাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
একদিকে আরব বিশ্ব ও ইসরাইল রাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যার নেতৃত্বে আছে ইরান ও সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়গুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই দুই ধারার দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ। যে দ্বন্দ্বটা চলছে তা আসলে ধর্মীয় মতভেদের কারণে নয় বরং ক্ষমতার লড়াইটাই এখানে মুখ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হামাস সুন্নি সম্প্রদায় কেন্দ্রিক হলেও ইরান তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে। এমনকি গোষ্ঠীগুলোও তাদের দ্বন্দ্বের প্রকৃতি অনুযায়ী আলাদা পক্ষ নিয়ে থাকে। যেমন, সিরিয়া যুদ্ধে হামাস ও হিজবুল্লাহ আলাদা পক্ষ নিলেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে তারা আবার ঐক্যবদ্ধ।
মধ্যপ্রাচ্যের এ সংঘাতে গোটা বিশ্ববাসীই উদ্বিগ্ন। এমনিতেও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপের কতিপয় দেশের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতেও। যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার বৈশ্বিক পরিবেশকেও করে তুলছে দুর্বিষহ। খাদ্য, জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদির চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। ফলে পরিস্থিতি এরই মধ্যে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ইরান-ইসরাইল বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশের তালিকায় শীর্ষ ২০-এ অবস্থান করছে। তাদের সমর্থনে যেসব শক্তিধর দেশ রয়েছে সামরিক শক্তিতে তাদের অবস্থানও তালিকার ওপরেই। কাজেই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃত্বকে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসা প্রত্যাশিত থাকলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। যুদ্ধ কেবল ধ্বংস বাড়ায়, মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ যুদ্ধের পক্ষে থাকে না। বরং যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ^বিবেককে জাগানোর ব্রত পালন করে। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। চাই হিংসা-বিদ্বেষহীন, উদ্বেগহীন, বৈষম্যহীন, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব। সংঘাত বন্ধে বিশ্ব নেতৃত্ব অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিক, অগ্নিগর্ভ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নেমে আসুক এটাই প্রত্যাশা।