প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের ৭৯ অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, এখন একটি শক্তিশালী অর্থনীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাই অন্তর্র্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। এজন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন-সহযোগিতা আরও ব্যাপক ও গভীরতর করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বাংলাদেশ। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ প্রযুক্তি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
ড. ইউনূস ভাষণে বলেন, জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের অফুরন্ত শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে।
এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে, কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্র-জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এ সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের এবার বিতর্কের মূল প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে, ‘কাউকে পিছিয়ে রাখা নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানব মর্যাদার অগ্রগতিতে একসঙ্গে কাজ করা’। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এটিই ছিল আহ্বান। তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছাড়াও মার্কিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য তিনি মার্কিন ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বন জানান। সেই সঙ্গে অধিক পরিমাণে বাংলাদেশী পণ্য নেওয়ারও আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানির অন্যতম বাজার।
অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক সংস্কার চেয়েছে এবং সাড়াও পেয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি। ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলা চলে। আসছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। বৈদেশিক সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জুলাই দেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার। যা পরবর্তী মাসে বেড়ে ২ হাজার ৫৯ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে প্রতিডলার ১২০ টাকা দরে লেনদেন হচ্ছে। যার ফলে, রিজার্ভের ক্ষয় আপাতত বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না।
আগস্টের প্রথম তিনদিনে দেশে মাত্র ৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ৪ থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে প্রবাসীরা ৩৮ কোটি ৭১ লাখ ডলার, ১১ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ৬৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার এবং ১৮ থেকে ৩১ আগস্ট সময়ে ১০৮ কোটি ৭১ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। উল্লেখ্য, রেমিটেন্স আহরণে শীর্ষস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ব্যাংকটি আগস্টে ৪০ কোটি ৫২ লাখ ডলার রেমিটেন্স এনেছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড। যার মাধ্যমে এসেছে ২৯ কোটি ডলার।
এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত রবিবার সচিবালয়ে জাইকা, এডিবির প্রতিনিধি এবং অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার নারদিয়া সিম্পসনের সঙ্গে তিনটি আলাদা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান তিনি। অপরদিকে আইএমএফের প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
এমতাবস্থায় আশা করা হচ্ছে যে, ভঙ্গুর অর্থনীতি অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত। গত দেড় দশক সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন দুষ্টচক্রের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ দেখভাল করতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছর ধরে ক্রমেই কমছে। শেখ হাসিনার সরকার শেষ সময় পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থপাচার এবং তা ঢাকতে মিথ্যা তথ্য প্রদান করা। দেশ থেকে গত ১৬ বছরে প্রায় ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এ দেশের সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারীসহ অনেকেই বিদেশে অর্থপাচার করেছেন। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা জন্ম নিয়েছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।
দেশের অর্থনীতিতে কর আহরণ পদ্ধতি মানুষের আয় অনুপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর প্রদান করে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। দেশের প্রায় ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে। তবে ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, মাত্র ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ আয়কর প্রদান করেছে। প্রত্যক্ষ কর আহরণের হার কম হওয়ায়, আমাদের পরোক্ষ কর আহরণের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে।
পরোক্ষ করের ওপর অতিনির্ভরতার অর্থ হলো সমাজের দরিদ্র শ্রেণির ওপর বেশি অনুপাতে কর প্রদানে বাধ্য করা। দেশে ধনী-গরিবের কর প্রদানের আনুপাতিক যে বৈষম্য রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ সঠিকভাবে আয়কর আহরণ করতে ব্যর্থ হওয়া। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ কর আহরণ খাতের সংস্কার সমাজে আয়বৈষম্য দূর করতে অত্যাবশ্যক। আর যত দ্রুত তা শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশ গঠনে বিশ্ববাসীর সহায়তা, বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের রূপরেখা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তিনি তুলে ধরেন ভাষণে। বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, এমন বক্তব্যও দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেটিরও বর্ণনা দেন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অন্যান্য বৈশ্বিক-আঞ্চলিক বিষয়গুলো ভাষণে তুলে ধরেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ এবং আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন