ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১

বন্যাপরবর্তী নদীভাঙন

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২ অক্টোবর ২০২৪

বন্যাপরবর্তী নদীভাঙন

সম্পাদকীয়

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক সুপ্রাচীন ও গভীর। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ও বৃহৎ সভ্যতাগুলো। বাংলাদেশের বুক চিরেও ছোট বড় অনেক নদ-নদী বয়ে গেছে, যেগুলো এক সময় ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রা সমুচ্চ রাখাসহ কৃষিকাজের সেচের প্রধান উৎস হিসেবেও কাজ করে আসছে নদীগুলো। সাধারণত বর্ষাকালে নদীর প্রবাহের বিস্তৃতি অনেক বেশি থাকে।

বর্ষা শেষে স্রোত ও পরিধি অনেক কমে যায়। এতে নদ-নদীর দুকূলে সৃষ্টি হয় ভাঙন। বন্যার কারণেও নদীভাঙন দেখা দেয়। সম্প্রতি দেশে কয়েক দফা বন্যা হয়েছে। ফলে, বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে ইতোমধ্যে পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে বন্যার ক্ষত। এসব অঞ্চলের নদীপাড়ের মানুষ এখন রয়েছেন নদীভাঙন আতঙ্কের মধ্যে। 
বেসরকারি এক গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তাদের আবার বেশিরভাগই পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে শহর অভিমুখে ছোটেন। সত্তর ও আশির দশক থেকে দেশে নদীভাঙনের তীব্রতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতি। প্রতিবছর দেশে গড়ে আট হাজারের বেশি হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে থাকে, যার বেশির ভাগ কৃষিজমি। ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই টাকার অভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করতে না পারায় তাদের গৃহহীন, ছিন্নমূল জীবনযাপন করতে হয়।

নদীভাঙনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ফলে, বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত অভাবের তাড়নায় হাতে থাকা অবশিষ্ট জমি, গবাদিপশু এবং মূল্যবান সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কাজেই নদীভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসতভিটাসহ আবাদি ও মূল্যবান জমি বাঁচানো আবশ্যক।  কিছু পরিবার কষ্ট করে সম্পদ ধরে রাখতে সক্ষম হলেও হয়ে পড়েন অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত। তাছাড়াও নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া জমি এক সময় জেগে উঠলে, তা দখলের জন্য শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তখন বিশ্ঙ্খৃল পরিস্থিতিতে ঝগড়া-বিবাদ, রক্তপাত ও মামলা মোকাবিলায় হয়রানিতে পড়েন কেউ কেউ।

দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির মূল্য ও গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নদীভাঙন প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী জমি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে ভাসমান লোকের সংখ্যা ও দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 
দেশে নদীভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নদীভাঙনের শিকার এলাকার উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। দেশী-বিদেশী অনেক সাহায্য সংস্থা অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। তা না করে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নদীভাঙন ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এতে প্রকল্পের অর্থের সর্বাধিক সুষ্ঠু বণ্টন ও সদ্ব্যবহার সম্ভব।

নদীতে চর জেগে উঠলে ভাঙনের শিকার তথা ক্ষতিগ্রস্তরা যেন নিজেদের জমি ঠিকমতো ফিরে পেতে পারে, সে বিষয়ে প্রশাসনকে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। তদুপরি দেশের নদীরক্ষা এবং নদীভাঙন রোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও বেশি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

×