ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সকলে সচেতন হই

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২১:০২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সকলে সচেতন হই

ভয়াবহ ডেঙ্গুর সংক্রমণে জনজীবন শঙ্কিত

ভয়াবহ ডেঙ্গুর সংক্রমণে জনজীবন শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, প্রায় দিশাহারা। মশাবাহিত রোগটির সর্বনাশা দাপটে পরিবার থেকে পুরো সমাজে যে নেতিবাচক প্রভাব তা যেন মহামারির দুর্বিপাক। তবে মৌসুমটাই এডিস মশার প্রজননের জন্য উত্তম। সেপ্টেম্বর মাস পেরিয়ে অপেক্ষমাণ পুরো অক্টোবর মাস। যা মশা ও পানিবাহিত রোগটির জন্য অনুকূল সময়। শরৎকালের সেপ্টেম্বর মাসের ¯িœগ্ধ সতেজ পরিবেশে নৈসর্গের রূপময়তা আবহমান বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক সম্ভার।

রোদ-বৃষ্টির চমৎকার সম্মিলনে নিত্য পরিবেশ পরিস্থিতির যে সতেজ অনুভব সেটা যুগ-যুগান্তরে নির্মাল্য। তবে প্রকৃতির সহজাত বিপন্নতাও নজর এড়ানোর মতো নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের বিপরীত আবহে নৈসর্গ তার চিরায়ত সম্ভার থেকে বিচ্ছিন্নতাই শুধু নয়, বরং বিলুপ্তির পথে। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে নিসর্গবিদরা আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন ‘ধরিত্রী বাঁচাও’ স্লেøাগানে। যা অবধারিত আশঙ্কিত যাত্রায় বিশ্ব দূষণের প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক আবেদনে সোচ্চার হচ্ছে।

যার প্রভাবে প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানদের নিত্যজীবনে যে অসহনীয় আঁচড় তাও চলমান শতাব্দীর আর এক বিষণœ প্রতিবেশ বলা যায়। অনাকাক্সিক্ষত এমন দুর্বিষহ প্রকোপে ষড়ঋতুর বিচিত্র আবহও যথাসময়ে প্রকৃতিতে সাড়া জাগাতে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ শরৎকালের সতেজ প্রতিবেশের বিপরীতে বৃষ্টি¯œাত পরিবেশকে আলিঙ্গন করছে। আর এমন স্যাঁতসেঁতে পরিবেশই এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল বলে চিকিৎসক ও পরিবেশবিদরা বলে যাচ্ছেন।

ইতোমধ্যে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। পূর্ণ বয়স্ক থেকে শিশু-কিশোর সবাই কম-বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, যা সত্যিই সারাদেশের জন্য মহাবিপদ সংকেত। শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক বাড়ার দিকে বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের শতকরা ১৯ ভাগই শিশু। এদের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। প্রতিদিন প্রায় হাজারের মতো আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

সর্বশেষ মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যাওয়ার চিত্র ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ থেকে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের। সেখানে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুর হারও তাদের বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও কীট বিশেষজ্ঞদের মতে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসই ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। বৃষ্টিপাত, বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রায় এডিস মশা যেন প্রজনন স্বাস্থ্যে এক অনন্য সময় পার করে।

তবে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাকি অনেকটাই নির্ভর করবে বৃষ্টিপাতের ওপর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যার মধ্যে ভাসমান মানুষের অবস্থা ইতোমধ্যে দুর্বিষহ। আর বৃষ্টির ধারা মানেই নানামাত্রিক জলাবদ্ধতার করুণ দৃশ্য। সেখান থেকে এডিস মশার যে ভরা যৌবন তাও পরিবেশ পরিস্থিতির আর এক নাজেহাল অবস্থা। বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে যাওয়া বাংলাদেশের একটি সাধারণ বিষয়। সেখানে দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের অবশিষ্ট আবর্জনায় বৃষ্টির পানি যথার্থভাবে বেরিয়ে যেতে যথেষ্ট সময় নেয়।

সঙ্গত কারণে আটকেপড়া পানি জলাবদ্ধতায় রূপ নেওয়া নতুন কিছু নয়। লাগাতার দুর্ভোগ তো বটেই। ভরা বর্ষায় উন্নয়নশীল বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্তর জলমগ্ন হতেও যেমন সময় লাগে না, একইভাবে বন্যার্ত মানুষের জীবন, সম্পদ সেভাবে সুরক্ষিত থাকতেও হিমশিম খায়। আর এডিস মশা নাকি স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন জমে থাকা বৃষ্টির পানিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং এটি তাদের প্রজনন সক্ষমতার উপযোগী পরিবেশও। যেখানে-সেখানে কিংবা অস্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তারে যেন তাদের চরম অনীহা। এমনই বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তা অবশ্য গবেষণালব্ধ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে জনসমক্ষে হাজিরও হচ্ছে।
নিত্য ডেঙ্গু রোগ বাড়ার দুঃসংবাদ সত্যিই এক আবশ্যকীয় দুর্ভোগ। বিশেষ করে গত মাসের শেষ সপ্তাহে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর দুঃসংবাদ বিচলিত হওয়ার মতোই। সেটা সারা মাসের সংখ্যা। আবার সংক্রমণ হওয়ার শুরু থেকে মোট মৃত্যু দেড় শতাধিক। অক্টোবর মাসে সংক্রমণ এবং মারা যাওয়ার শঙ্কা বাড়ার দিকেই থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

চলতি অক্টোবর মাসের শেষে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা সময়ের হাতে। এডিস মশার শুধু  চারপাশের জমে থাকা পানি নয়, বরং বসতবাড়ির মধ্যে পাত্রে রাখা পানিও বেশ পছন্দ। সেখানে তারা প্রজনন লার্ভা ছেড়ে দিয়ে ডেঙ্গু সংক্রমণকে অনেক বাড়িয়ে তোলে। তবে যেমন পানিতেই এডিস মশা বংশ বিস্তার করুক না কেন তা প্রতিরোধ করা জরুরি। সেটা বসতবাড়ির ভেতর-বাহির সব জায়গার জন্যই নিতান্ত দায়বদ্ধতা।

সব দায়-দায়িত্ব শুধু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারের একার নয়, বরং সম্মিলিত কর্মসূচি, পরিবেশ সুরক্ষা ও সচেতন দায়বদ্ধতায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকানো এখন সময়ের দাবি। ফলে নিজ বসতবাড়ির আঙিনা এবং চারপাশের পরিত্যক্ত জায়গায় পানি জমতে না দেওয়াই সর্বোত্তম উপায়। বাসাবাড়ির অভিভাবকরা যদি নিজ দায়িত্বে অনেক কাজ কমিয়ে আনতে পারেন বাকিটা সিটি করপোরেশন বা সরকারি সংস্থা আমলে নিয়ে করে দিলে সমস্যার যথাযথ সমাধান সহজসাধ্য হয়ে যায়। 
দেশে এখন সাড়ম্বরে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের অবধারিত যাত্রা। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ থেকে সড়ক-মহাসড়কের নিত্য-নতুন কর্মযোগ দৃষ্টিনন্দনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার সোপান। এমন সব নতুন জমজমাট প্রকল্পের বিপরীত প্রতিক্রিয়া সব সময় সুখকর ও স্বস্তিদায়ক নয়। উন্নয়ন মহাপ্রকল্পের হরেক আবর্জনাও পরিস্থিতিকে বেসামাল করে পরিবেশকে নানামাত্রিক সংকটের আবর্তে ফেলে দেয়। নির্মাণাধীন সড়ক-মহাসড়কের চারপাশে থাকে আবর্জনার স্তূপ, যা তাৎক্ষণিক কর্মপরিকল্পনায় সরিয়ে ফেলা উচিত।

এর অন্যথা পরিস্থিতিকে শুধু বিষময় নয়, বাসের অযোগ্য করে তুলতেও সময় নেয় না। পরিবেশ দূষণের নির্মমতায় বিপাকে পড়ছে সন্তানসম্ভবা মা আর গর্ভের শিশুটিও। দূষণের শিকার হয়ে জগতের আলো দেখা সদ্যজাত শিশু সন্তানটি কিন্তু বড়ও হচ্ছে আর এক প্রতিকূল পরিবেশে, যেখানে তার শ^াস-প্রশ^াসের নির্মল বাতাস থেকেও সে বঞ্চিত হয়ে থাকে। 
গ্রামনির্ভর বাংলাদেশে সিংহভাগ মানুষই সবুজ পল্লীর সুরম্য প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন কাটায়। তেমন চিত্র আমাদের আশ^স্ত করে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় শ্যামল পল্লীর সবুজ পরিবেষ্টিত গ্রাম আদৌ জলবায়ু দূষণ থেকে কতখানি মুক্ত। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে আসে রান্নার যে জ্বালানি ব্যবহার করা হয় সেটা গ্রাম কিংবা শহরে যেখানেই হোক না কেন সেখানেও পরিবেশ দূষণের হরেক মাত্রা থাকে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক-মহাসড়কের পাশের গাছ কাটা থেকে শুরু করে বন উজাড় করার যে দৃশ্য প্রতীয়মান হচ্ছে সেখানে পরিবেশ দূষণের চিত্র সত্যিই আশঙ্কাজনক। আমরা জানি গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের মধ্যে থাকা অক্সিজেন বাতাসে ছেড়ে দেয়। শস্য, শ্যামল সবুজ পল্লীও আজ দূষণের ভারে আক্রান্ত, বিপন্ন, বিষণœœ। তাই পরিবেশ দূষণের মধ্যে যদি আবার রোগ-বালাইয়ের কঠিন বলয় আশঙ্কিত পর্যায়ে চলে যায় তাহলে প্রকৃতির কোলে লালিত মানুষের সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়?

সুতরাং মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণে সবার আগে একটি নির্মল ও স্বচ্ছ পরিবেশ নিতান্ত জরুরি। তার সঙ্গে নিজের তাগিদে চারপাশের স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনাও এক অনবদ্য চাহিদা। 
ডেঙ্গু সংক্রমণ চিহ্নিত করে তার নিরাময়ের সুবন্দোবস্ত করতে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আগে রোগটা ডেঙ্গু কি না সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গুর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমন ধরনগুলো চিহ্নিত করে উপশমেরও সুব্যবস্থা করতে হবে রোগী কিংবা তার স্বজনদের। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সর্বপ্রথম অসহ্য মাথার যন্ত্রণায় কাতর হতে হয়। কাঁপুনি দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াও রোগটির গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। শারীরিক ব্যথা-বেদনাও রোগীদের তীব্র যন্ত্রণায় কাহিল করে দেয়।

প্রাথমিকভাবে তাপমাত্রা আর ব্যথা-বেদনা কমার জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ সেবনে রোগীদের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাপমাত্রা আর ব্যথা উপশমে যদি প্যারাসিটামল কাজ দেয় তাহলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, যাতে রোগী সম্পূর্ণভাবে নিরাময়বোধ করতে পারেন। তবে চিকিৎসকদের মূল্যবান পরামর্শ ও নির্দেশনা হলো ডেঙ্গুকে কোনোভাবেই কাছে আসতে দেওয়া যাবে না। তার আগেই সমূলে বিনাশ করা সর্বোত্তম পন্থা। সচেতন ও সাবধানতায় এডিস মশার লার্ভা থেকে সকলকে দূরে থাকার চেষ্টা করা উচিত।

চারপাশের পরিবেশ, খানা-খন্দে কোনোভাবেই পানি জমতে দেওয়া যাবে না। আগে বসতবাড়ির মালিকরা তাদের গৃহকোণগুলো বিশুদ্ধতার আবর্তে ঢেলে সাজাবেন। শুধু বাইরে নয়, ঘরের ভেতরেও গামলা কিংবা বালতিতে দীর্ঘদিন পানি জমানো যাবে না। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর মারাত্মক সংক্রমণে যে দুঃসহ পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছিল তা আজও শিহরিত করার মতো।

পরের বছর ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে ডেঙ্গুসহ আরও কিছু রোগের সংক্রমণ কেমন করে যেন হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে ২০২৪ সালে তার আবার বাড়বাড়ন্ত, যা সত্যিই ভাবনার বিষয়। তবে উপশম কিংবা প্রতিকার সহজসাধ্য এবং হাতের নাগালেই। তাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নয়, বরং সচেতন দায়বদ্ধতায় রোগটিকে দূরে সরিয়ে রাখাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। 
লেখক : সাংবাদিক

×