ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

ইটভাঁটির আগ্রাসন জলবায়ুর জন্য হুমকি

আলম শাইন

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ইটভাঁটির আগ্রাসন জলবায়ুর জন্য হুমকি

দেশে ইটভাঁটির সংখ্যা ৮ হাজারের মতো

দেশে ইটভাঁটির সংখ্যা ৮ হাজারের মতো। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার ইটভাঁটি  বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের ইটভাঁটিগুলোতে বছরে ৭০০ কোটির মতো ইট তৈরি হচ্ছে। তাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টনের বেশি মাটির প্রয়োজন পড়ছে। ইট তৈরি করতে ভাঁটিগুলোতে বছরে কয়লা পোড়ানো হচ্ছে দুই মিলিয়ন টনের বেশি। পাশাপাশি লাখ লাখ টন বৃক্ষরাজি পোড়ানো হচ্ছে। যার সঠিক হিসাব আজ অবধি জানা যায়নি। তবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে, ৫০টি ভাঁটির জন্য প্রায় ৩০ লাখ মণ কাঠের প্রয়োজন হয়। ইটভাঁটিগুলো থেকে প্রতিবছর কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হয় ৮.৭৫ মিলিয়িন টন।

এ ছাড়াও ইটভাঁটি থেকে নির্গত হয় কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ধোঁয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাঁটির কারণে জলবায়ু এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ইটভাঁটি থেকে নির্গত কার্বন ও কার্বন মনোক্সাইড জলবায়ুর পাশাপাশি ফসলাদিসহ গাছগাছালির ব্যাপক ক্ষতি করছে। এ ছাড়াও ভাঁটির বর্জ্যে সালফার থাকার কারণে জলাশয়কে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। যার প্রভাব পড়ছে জলজপ্রাণী এবং উদ্ভিদের ওপরে। এতে করে অনেক প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে পড়েছে। কিছু কিছু জলজ উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের ফসলি জমি নিষ্ফলা হয়ে যাচ্ছে ভাঁটির আগুনের প্রচ- তাপে। 
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ইটভাঁটি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সাইউ অব সালফার। যা নির্গত হওয়ার ফলে রাজধানীর প্রায় ৫৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটছে। বাদবাকি বস্তুকণা ও জৈব যৌগ, জ্বালানি দহন ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার মাধ্যমে ঘটছে। বিশেষ করে ইটভাঁটি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে ঢাকা এবং আশপাশের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইটভাঁটির প্রভাবে আশপাশে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে চিমনি দিয়ে নির্গত কালো  ধোঁয়া প্রবাহিত হওয়া। কালো ধোঁয়া এবং অতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে আকাশে কোনো ধরনের মেঘ পুঞ্জীভূত হতে পারে না, বরং আকাশের মেঘকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাতে বিঘœ ঘটায়।
ইটভাঁটির সারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেলেও বৃহত্তর ঢাকা জেলার সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে প্রচুর নজরে পড়ে। এমনকি বান্দরবান জেলার পাহাড়সংলগ্ন বন, প্রান্তরেও বেশ কিছু ইটভাঁটির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে পাহাড় কেটে কাঁচা ইট বানানো হচ্ছে এবং ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের বৃক্ষরাজি। তাতে পাহাড়ের অস্তিত্ব বিলীনের পাশাপাশি উজাড় হচ্ছে বন-বনানী।

জানা গেছে, বছরে কয়েক লাখ ঘনফুট কাঠ পোড়ানো হচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চলের ভাঁটিগুলোতে। এ ছাড়াও ইটভাঁটির বিষাক্ত ধোঁয়া ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস আশপাশের পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। বিপর্যয় ঘটাচ্ছে ভাঁটিসংলগ্ন স্কুল-কলেজের পরিবেশেরও। যা থেকে গ্রিনহাউসের প্রতিক্রিয়াও ঘটে ব্যাপকভাবে। ইটভাঁটির মালিক পক্ষ প্রভাবশালী বিধায় স্থানীয় পরিবেশকর্মী কিংবা সচেতন মহল বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদেরও সুযোগ পাচ্ছেন না।

ইটভাঁটির মালিকরা যদি একটু সতর্ক বা সচেতন হতেন, তা হলে এ ক্ষতিকর দিক থেকে দেশ, জাতি কিংবা পরিবেশটাকে বাঁচাতে পারেন অবলীলায়। সাশ্রয় করতে পারেন নিজেদের অর্থনৈতিক দিকটাও। এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে ইটভাঁটিগুলোকে ইট কারখানায় রূপান্তরিত করা।
এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কারখানার নাম ‘ইকো-ব্রিকফিল্ড’। এটি চালু করেছে ‘কিলন এনার্জি অল্টারনেটিভ’ (সিইএ) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। ইট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, ‘হফম্যান কিলন’ নামক এক ধরনের উন্নত প্রযুক্তি। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে চীনের জিয়াং রিসার্চ অ্যান্ড ডিভাইস ইনস্টিটিউট অব ওরাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস। ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরির প্রকল্পটি কয়েক বছর আগে সাভারের ধামরাই উপজেলায় চালু হয়েছিল। ইটভাঁটির মালিকদের উৎসাহিত করতে প্রকল্পটি হাতে নেয় ‘সিইএ’।

সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলাতেও ‘ইকো-ব্রিকফিল্ড’ চালু হয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে ইট তৈরিতে ধোঁয়ার সৃষ্টি না হওয়ায় কার্বন নিঃসরণের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। যে সামান্য ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, তা সংরক্ষণ করে আবার ব্যবহার করা যায় ড্রায়িং চেম্বারে। ইকো-ব্রিকফিল্ডের বেশ কয়টি আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন মাটি সাশ্রয় হয় ৭০ ভাগ। ইট তৈরির উপযুক্ত মাটির সঙ্গে ৩০ ভাগ কয়লার গুঁড়া মিশিয়ে ম- তৈরি করে মেশিনের সাহায্যে টুকরো করা হয়।

টুকরাগুলো সরাসরি ড্রায়িং চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেই মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যেই ইট তৈরি হয়ে যায়। এতে কাঁচা ইট তৈরির ঝামেলা নেই মোটেও। অন্যদিকে, পুরনো পদ্ধতিতে ইট পোড়াতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। তাতে অর্থ অপচয় হয় যেমন তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে চিমনি দিয়ে নির্গত হতে থাকে কালো ধোঁয়া। এর প্রভাবে পরিবেশের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা বোধ করি আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। সনাতনী পদ্ধতিতে ইট তৈরি করলে খরচ পড়ে বেশি। ইকো-ব্রিকফিল্ডের মাধ্যমে খরচ পড়ে কম।
সুখবর হচ্ছে, ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরিতে এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। এর জন্য তারা হাতে নিয়েছে ‘হাইব্রিড হফম্যান কিলন’ প্রযুক্তি। এতে খরচ পড়বে অর্ধেকের মতো। সংস্থাটি বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ১৫টি ‘এনার্জি ইফিশিয়েন্সি কিলন’ স্থাপন করা হবে। আগামী কয়েক বছর ধরে তারা এ পরীক্ষামূলক কাজটি করবে। পদ্ধতিটি অব্যাহত থাকলে সনাতনী ইটভাঁটিগুলো রূপান্তরিত হবে ইট কারখানায়।
উল্লেখ্য, গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বায়ুদূষণের কারণে উন্নত বিশ্বে এখন আর ইটের ব্যবহার করছে না। তারা বালু-সিমেন্ট ও পাথরের টুকরোর মিশ্রণকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্লক-কাদামাটির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ যোগ করে ইট তৈরি করছে, যা ওজনেও হাল্কা।
পরিবেশ অধিদপ্তর এ ব্যাপারে আধুনিক প্রযুক্তির হাইব্রিড হফম্যান কিল্ন, জিগজ্যাগ কিল্ন ও ভার্টিক্যাল শ্যাফ্ট কিল্ন এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ইটভাঁটি তৈরি করতে মালিকদের উৎসাহিত করছে। তারা যদি এসব উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ করেন, তা হলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হবে তেমনি লাভবান হবেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। মালিক পক্ষ একটু সচেতন হলেই ‘জিগজ্যাগ’ পদ্ধতির মাধ্যমে ইটভাঁটিকে ধোঁয়াবিহীন ইট কারখানায় রূপান্তরিত করতে পারেন। ইট কারখানায় রূপান্তরিত হলে যেমন বৃক্ষরাজি রক্ষা পাবে, তেমনি কালো ধোঁয়া ও কার্বন মনোক্সাইডের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ। অপরদিকে স্বল্পমূল্যে ইট ক্রয়-বিক্রয়েরও সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি উপকৃত হবে দেশ ও জাতি। বেঁচে যাবে অসংখ্য বৃক্ষরাজিও। কমে আসবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও। তাতে গড়ে উঠবে সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ।


লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

×