ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের গৌরবগাথা

মেজর আবু রুশদ্ মোহাম্মদ সাঈখ, এমফিল, এইসি

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের গৌরবগাথা

বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের গৌরবগাথা

ভিন্ন এক সংস্কৃতি। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রীতিনীতি। প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতিও নিজ দেশের মতো নয়। তবুও এমন পরিবেশ পরিস্থিতির মাঝেও নিজেদের সেরা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। যার মূলে রয়েছে উচ্চ পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, মানবিকতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ।

এসব গুণাগুণের কারণেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অন্যদের কাছে অনন্য এক রোল মডেল। খোদ জাতিসংঘ এবং মিশন সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় জনগণের মুখ থেকেও বহুবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম ও গৌরবগাথা।
উল্লেখ্য, মে ২০২৪-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের গর্বিত শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের ৪৩টি দেশ/স্থানে ৬৩টি মিশন/অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করেছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বমোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন 
শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে মোট ১০টি দেশে সর্বমোট ১১টি মিশনে ৪,৯৭০ জন সেনাসদস্য নিয়োজিত আছেন (অন্যান্য বাহিনীসহ ৬,০৯২ জন)। এই মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বমোট ১৩১ জন নিহত এবং ২৩৯  সদস্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা বিশ্ব শান্তিরক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ ত্যাগের এই যে দৃষ্টান্ত সেটা সাধারণত অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে একেবারেই কম অথবা কারও কারও ক্ষেত্রে উদাহরণ খোঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে যাত্রার শুভ সূচনা করেছিল, তা আজও গৌরবদীপ্তভাবে চলমান রেখেছে। 
শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত হয়ে এবং একাধিকবার পরিদর্শনের সুযোগ পেয়ে এমন অনেক ঘটনা বা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি যে, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা শান্তিরক্ষীদের অবদানের ফলে স্থানীয়দের যে ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাস দেখেছি তা গর্ব করার মতো। ২০২১ সালের ১ জুলাই সেনাবাহিনীর মিডিয়া টিমের সঙ্গে শান্তিরক্ষা মিশন পরিদর্শনের জন্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে যেতে হয়েছিল।

দীর্ঘ প্রায় ৩০ ঘণ্টার আকাশপথ (ট্রানজিটসহ) পেরিয়ে প্রথমেই গিয়েছিলাম কঙ্গোর উত্তরাঞ্চলের গোমা শহরে। ওই শহরে যখন সড়কপথে চলেছি, তখনও শান্তিরক্ষী সেনাবাহিনীর জীপ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে স্থানীয় কিশোর-যুবকরা ‘বাংলাদেশ’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল। হাত নেড়ে শুভেচ্ছাও জানাচ্ছিল অনেকে। কঙ্গোর গোমা শহরের একটি এলাকায় বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশের (ব্যানএমপি) ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে মিডিয়া টিমের সৌজন্যে একটি আয়োজন ছিল।

সেই আয়োজনে দেখা গেল অনেকের কণ্ঠে সমস্বরে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করছিল কঙ্গোর স্থানীয় কিশোর-যুবকরা। ‘আমার সোনার বাংলা... আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কিছুক্ষণ পর পরিবেশিত হলো, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ জনপ্রিয় বাংলা গান। এরা কোনো বাঙালি নন, কিন্তু কি যে সাবলীলভাবে তারা বাংলায় গান গাইছিলেন, সত্যিই বিস্ময়কর। এর নেপথ্যের কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠায়, ধীরে ধীরে তারা বাংলা ভাষার বিভিন্ন শব্দ ও কিছু গান আয়ত্ত করেছেন।

এখান থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, কঙ্গোতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্থানীয়দের কাছে কতটা জনপ্রিয় এবং আস্থার। শুধু কঙ্গোতেই নয়, সাহারা মরুভূমির দেশ মালি, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সাউথ সুদানসহ শান্তিরক্ষা মিশন চলা দেশগুলোতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নানা ক্ষেত্রে নিজেদের উচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক ও বন্ধুবৎসল আচরণ দিয়ে সবার মন জয় করেছে। গোষ্ঠীগত দাঙ্গা বা দ্বন্দ্ব-সংঘাত মোকাবিলা করে স্থানীয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আস্থার প্রতীক হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। 
এদিকে দায়িত্বের বাইরে গিয়েও এসব দেশে ‘সিভিল মিলিটারি কো-অপারেশন (সিমিক)’ প্রোগ্রামের আওতায় নানা সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে বরাবরই জাতিসংঘের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা। সিমিক কর্মকাণ্ডের মূলেই রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা।

এই সিমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পেন পরিচালনাসহ বিনামূল্যে ঔষুধ বিতরণ ও চিকিৎসা সহায়ক উপকরণ বিতরণ, বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী বা বাংলাদেশ পুলিশের শান্তিরক্ষীরাও নানা ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট প্রশংসিত। এসব সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও রোল মডেল। 
একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করা যাক। সেটি হচ্ছে- ২০২১ সালের মে মাসের শেষদিকে কঙ্গোর গোমা শহরের অদূরে ‘নাইরোগঙ্গো’ আগ্নেয়গিরিতে আকস্মিক ভয়াবহ এক উদ্গিরণ হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর আগ্নেয়গিরির লাভা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে তুলনামূলক নিচু এলাকা গোমা শহরসহ চারিদিকে। এর মাঝে বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীদের অনেক ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা যখন বন্যার পানির মতো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন স্থানীয় সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ এলাকার দিকে ছুটছিলেন। বিস্ফোরণে ভূমিকম্প হয়। রাস্তাঘাট অনেক স্থানে দেবে যায়, ভঙ্গুর অবস্থার সৃষ্টি হয়। উদ্গিরণের ওই সময়ে যে যেভাবে পারে নিজের জীবন নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে। এর ব্যতিক্রম ছিল না কেউ। অনেকেই পরিস্থিতি দেখে দ্রুত নিরাপদ এলাকায় সরে যান। কেননা, ওই নাইরোগঙ্গো আগ্নেয়গিরির সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশেই শান্তিরক্ষীদের বেশির ভাগ ক্যাম্প।

অথচ, এই পরিস্থিতিতেও ব্যতিক্রম ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। কারণ, নিজেদের জীবন নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে না গিয়ে বরং কঙ্গোর ওই এলাকার স্থানীয় নারী-শিশুসহ অসহায় মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। বিপুল সংখ্যক স্থানীয় সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে সে সময়েও প্রকৃত মানবতা দেখিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। এমনকি ওই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও লাভা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় আশপাশের প্রায় শত কিলোমিটার রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্ট ও বহু সেতু-কালভার্ট মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সেখানেও শান্তিরক্ষী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কন্টিনজেন্ট (ব্যানইঞ্জিনিয়ার) সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে রাস্তাঘাট ও ব্রিজসহ অবকাঠামো সংস্কার-নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এসব কারণেই কঙ্গোর সাধারণ মানুষের মাঝে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশ পেয়েছে বারবার। 
আফ্রিকার দেশ কঙ্গো বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে কয়েকগুণ বড়। দেশটির মাটির নিচে শুধু যেন স্বর্ণসহ নানা খনিজ সম্পদের খনি। প্রাকৃতিক সম্পদে মোড়ানো এমন একটি দেশেও দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে গোত্র বা গোষ্ঠীগত রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব-সংঘাত। কঙ্গোর বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ অতি শান্তিপ্রিয়। তবে বড় অংশই দরিদ্র ও অসহায়। এমনই এক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কঙ্গোর সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের 
শান্তিরক্ষীরা আপনজনের ভূমিকায় সব সময় অবস্থান করেছে। বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাদান, দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবকদের সাবলম্বী করাসহ এমন সব কর্মকাণ্ডের কারণে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক লাল-সবুজের পতাকাবাহী শান্তিরক্ষীরা। কেবল এটি কঙ্গো নয়, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সাউথ সুদানসহ যেসব দেশেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালন করছে বা করেছে, সেখানেই উচ্চ পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, মানবিকতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দিয়ে জয় করেছে সেখানকার স্থানীয় মানুষের বিশ¡াস ও অকৃত্রিম ভালোবাসা। এর মাধ্যমে জাতিসংঘ থেকেও বহুবার মিলেছে ভূয়সী প্রশংসা। উচ্চ পেশাদারিত্ব সমুন্নত রাখার কারণে জাতিসংঘের নির্দেশে অনেক দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা আভিযানিক ক্ষেত্রেও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। 
শান্তিরক্ষীদের ভূমিকাসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে ২০২১ সালের জুনে জাতিসংঘের একটি ‘ভিজিটর টিম’-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কঙ্গোর (মনুস্কো) তৎকালীন ফোর্স কমান্ডার ব্রাজিল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এক সেনা কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, কঙ্গোর মধ্যে বুনিয়া ও বেনি এলাকা সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসপ্রবণ। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বড় কন্টিনজেন্ট অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা এখানে অত্যন্ত শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করছেন। মূল দায়িত্বের বাইরেও নানা সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। সত্যি বলতে, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমসহ নানা কাজের কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রতি জাতিসংঘ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনিও অত্যন্ত খুশি।
এছাড়া গত বছরের তথা ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক ‘মিডিয়া ভিজিটে’ গেলে সেখানেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের পেশাদারিত্ব ও মানবিক গুণাবলির ব্যাপক প্রশংসা শোনা যায়। 
সেখানে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের শান্তিরক্ষী কর্মকর্তাদের মুখে নিজ বাহিনী বা দেশের প্রশংসা শুনে সত্যিই গর্ববোধ হচ্ছিল। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকের এ সময়টা ছিল জাতিসংঘের মালি মিশনের (মিনসুমা) সমাপ্তির মুহূর্ত। মালি মিশন (মিনসুমা) পরিদর্শনে গেলে আমাদের কথা হয় মিনসুমার হেড অব অফিস, গাও সেক্টরের সঙ্গে। জাতিসংঘের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেদিন মিডিয়া টিমকে বলেছিলেন, বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা সব সময় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন।

তাদের সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্টগুলো (শান্তিরক্ষী) স্থানীয় জনগণের সঙ্গে খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত থেকে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা খুব সহজেই স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। মূলত এসব গুণের কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অন্যদের চেয়ে আলাদা। যা তাদের (বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী) শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালনাকে অনেক সহজ করেছে, তেমনি দেশের সুনামও বাড়িয়েছে। মালির গাও প্রদেশে সেই সময়ে নিযুক্ত ইস্ট সেক্টর কমান্ডার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশের 
শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত পেশাদার এবং দায়িত্বশীল। এছাড়া তাদের অনেক মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড আছে যা তাদের অনন্য করে তুলেছে। ভিনদেশী শীর্ষ স্থানীয় শান্তিরক্ষী কর্মকর্তাদের মুখের কথাগুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের মর্যাদা অনেক উচুঁতে কিংবা তাদের অনন্য সুনাম তাদেরই কর্মগুণের ফল। এই সুনাম-মর্যাদার অবস্থান মূলত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই অর্জন করেছে। 
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রতি ওইসব দেশের স্থানীয় জনগণ, সরকার এবং জাতিসংঘের এমন প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা সত্যিকার অর্থেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের কাছে শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশের মর্যাদা সমুজ্জ্বল করছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সামরিক বাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে/স্থানে ৪৩টি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছে।

বর্তমানে ৪ হাজারেরও অধিক শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করছে। জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুসারে যা যা দায়িত্ব পালন করা দরকার, তা শতভাগ করেই এবং নানা মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখনো অনন্য, এখনো সেরা। 
শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 
শান্তিরক্ষীরা যখনই কোনো এলাকায় মোতায়েন হয়েছেন, সেখানে গিয়ে প্রথমে স্থানীয় সাধারণ মানুষদের আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের যে স্বাভাবিক বহির্প্রকাশ আছে, সেটাই স্থানীয়দের কাছে বাংলাদেশকে জনপ্রিয় করেছে। বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীরা যে কোনো স্থানে দায়িত্ব পালনে গেলে স্থানীয় সাধারণ নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে থাকে। কোনো নারীকে সহযোগিতা করতে চাইলেও সেখানে অবশ্যই নারী শান্তিরক্ষীদের নিয়োজিত করা হয়।

অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই যে উচ্চমানের পেশাদারিত্ব সেটাকে স্থানীয় জনগণ অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে থাকে। তাদের বিপদে আপদে আপনজনের মতো করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। এভাবেই নিজেদের দক্ষতা, পেশাদার আচরণ, আন্তরিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি স্থাপনে অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

যার মাধ্যমে বিশ^ পরিমণ্ডলে গর্বিত হচ্ছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ, গর্বিত হচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট হচ্ছে ১৯৮৮ সালে তৎকালীন ইরাক-ইরান যুদ্ধ বিরতির অবস্থায় মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের হয়ে প্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 
১৫ জন কর্মকর্তা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী (পর্যবেক্ষক) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। এরপর অচিরেই গোলযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ। লাল-সবুজের বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সেই মিশন  এখন  বিশে^ রোল মডেল।

×