ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

পার্বত্য সমস্যা এবং সেনাবাহিনী

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পার্বত্য সমস্যা এবং সেনাবাহিনী

দেশের পার্বত্যাঞ্চলসহ আশপাশে অশান্তি সৃষ্টির হোতারা দমে না

দেশের পার্বত্যাঞ্চলসহ আশপাশে অশান্তি সৃষ্টির হোতারা দমে না, দম নেয় মাঝে মধ্যে। সুযোগ পেলে আবার নেমে পড়ে। ঘটায় প্রাণহানিসহ নানা অঘটন। এবার চকোরিয়ার ডুলাহাজারায় কর্তব্যরত মেধাবী তরুণ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।

কেউ কেউ একে কেবলই ডাকাতদের কাজ বলে চিহ্নিত করতে চান। যেমন- এর আগে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কে  চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকে কেবলই এক বেপরোয়া পুলিশ কর্মকর্তার কুকর্ম বলে চালানো হয়েছে। হত্যা হত্যাই। সেটা গুলিতে হোক আর ছুরিকাঘাতে হোক। পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে হোক আর ডাকাত-পুলিশের হাতেই হোক।
পার্বত্য দুষ্টদের কাছে সেনাবাহিনী কমন শত্রু, তা বারবার প্রমাণিত। সেনাবাহিনী মোতায়েনের আগ থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতময় পরিস্থিতি। তাদের দমানোর চেষ্টা পুলিশ, বিডিআর  আনসার কম করেনি। তারাও বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে যুক্ত হয় সেনাবাহিনীর অপারেশনাল কার্যক্রম। এতে সাফল্য আসে। সাধারণ পাহাড়িদের কাছে ভরসাস্থল হয়ে ওঠে সেনা সদস্যরা। আবার সেই সাফল্যকে ম্লান করার অপচেষ্টাও চলেছে। সুদূর প্রসারী কুচিন্তায় সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের নানা যুক্তি ছোড়া হয়েছে। কেওয়াজ বাঁধানো হয়েছে। দেশ-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের রসায়নেই এ কেওয়াজ।
প্রতিবেশী ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও মিয়ানমারের নানা রাজ্যও এ সমস্যায় কাহিল। বাংলাদেশের মতো নিয়ন্ত্রণের ধারেকাছেও যেতে পারছে না তারা। বরং দিনকে দিন তাদের সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সাফল্য তাদের কাছে চরম ঈর্ষার। দৃশ্যমান আরও নানা কারণে বাংলাদেশের তিন পার্বত্যাঞ্চলে বিশৃঙ্খলার  নেপথ্যে ভিনদেশী ইন্ধন অনেকটা ওপেন সিক্রেট।

তা বুঝতে মস্ত ভূরাজনীতি-কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। আবার সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতা বুঝতেও সামরিক বিশারদ হওয়া জরুরি নয়। কারা পাহাড়ি-বাঙালি বিভাজন টানেন, কারা সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ছবক দেন, তা সাদা চোখেই বোধগম্য। পার্বত্য অঞ্চলের সকল বাঙালি সেটেলার নয়। সেখানে সীমিত সংখ্যক বাঙালির বসবাস অনেক আগে থেকেই। 
কোনো কোনো গণমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা তুলে ধরা হয় চাকমা সার্কেল চিফ এবং চাকমা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে। অথচ সেখানে অন্যান্য ১২টি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক গোলযোগময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও  চাকমা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন এখনো ভারতে বসে নানা প্রচারণায় লিপ্ত।  এর অভ্যন্তরে গভীর দুরভিসন্ধি। এখানে দেশী-বিদেশী নানা গ্রুপ-উপগ্রুপের স্বার্থ জড়িত। মেজর ( অব.) সিনহাকে হত্যা করেছিল পুলিশ।

আর সম্প্রতি লেফটেন্যান্ট তানজিমকে হত্যা করল পুলিশের প্রশ্রয়ে তাগড়া হওয়া ডাকাত তথা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সিলমারা কিছু পুলিশ পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে রাখছে, বিষয়টি পরিষ্কার। সেই বিবেচনায় সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করতে গিয়ে লাশ হতে হলো কর্তব্যরত একজন সেনাকর্মকর্তাকে। সময় এসেছে সময়ক্ষেপণ না করে আর নানা ছবকে কান না দিয়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে শক্ত অ্যাকশনের।

পাহাড়ি এই সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটগুলোকে আর দমন বা নিয়ন্ত্রণ নয়, নিশ্চিহ্নই করতে হবে। এখানে ভারতসহ বঙ্গদেশে ঠগি নিধনের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৫৬ সালে মেজর-জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে স্যার উপাধি পেয়ে উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান কেসিবির ব্রিটিশ ভারতে ঠগি নিধনের জন্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছেন। 
পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি জনপদ দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সংঘাত-সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনাস্থলগুলো ঘুরে দেখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। ইনিয়েবিনিয়ে নয়, একদম সোজা কথায় তারা এসব ঘটনার  পেছনে বিদেশী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন।  সেই অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। সেই দৃষ্টে সেনা পদক্ষেপে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি শান্তও হয়েছে। কিন্তু তা সাময়িক। মোটেও চূড়ান্ত সমাধান নয়। দুষ্টচক্র থেমে নেই।

কুকর্মে ইস্তফা দিয়ে পালিয়েও যায়নি। এরা ছুঁতা খোঁজে। ১৮ সেপ্টেম্বর, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে ছুঁতা ধরে ঊচ্ছৃঙ্খল জনতার গণপিটুনিতে মো. মামুন নামের এক যুবকের মৃত্যু দুঃখজনক ঘটনা।  ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন দীঘিনালা কলেজ থেকে বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘর্ষ বাধে। এ সংঘর্ষের একপর্যায়ে লারমা স্কয়ারে দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। ১০২টি দোকান পুড়ে যায়। যার মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালিদের ২৪টি দোকান।

ওই রাতে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় গোলাগুলিতে পাহাড়ি তিন যুবকের মৃত্যু হয়। এর পেছনে পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফের মূল গ্রুপসহ কয়েকটি মহলের গুজব রটানো ছাড়াও নানা কারসাজি আর অজানা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি-পরিবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে একেবারেই ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে পুঁজি করে নানা রাজনীতির পাশাপাশি রয়েছে কূটনীতিও। সেখানে এখন আরেক ভিন্ন বাস্তবতা। 
তিন পার্বত্য জেলাকে দাঙ্গাকবলিত করার নানা চক্রান্ত। পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি একটি বাস্তবতা। আর ভৌগোলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে। পূর্বদিকে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে ত্রিপুরা, পূর্বদিকে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশ। অদূরে মিয়ানমার। পছন্দ-অপছন্দ, অম্ল আর মধুরÑ প্রতিবেশী কখনো বদলানো যায় না। তবে, প্রেক্ষিত বদল হয়।

প্রেক্ষিত বদলের  টাটকা উদাহরণ এখন বাংলাদেশ আর ভারত। তা শেখ হাসিনাউত্তর আর শেখ হাসিনাপূর্ববর্তী মোটা দুই দাগে স্পষ্ট। শেখ হাসিনাপরবর্তী বাংলাদেশকে ভারত কোন্ চশমায় দেখছে, তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছেও গরম খবর। ভারতের কোনো কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত হরেক খবরের ছড়াছড়ি। আর এটিই স্বাভাবিক। ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছাড়ার ঠিক দিন ১৫ আগে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরদিন দিল্লিতে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘ডিসটার্বিং ইন ঢাকা’।

এর মাঝে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে, তা আনুষ্ঠানিক জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হচ্ছে না, তাও জানান দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যাওয়ার দুদিন আগে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার তৌহিদ হোসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তা খোলাসা করেন।

একইদিন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন ভারতের বিষয়ে বেশ ঝাঁঝালো বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের দুঃখজনক ঘটনায় বাইরের ষড়যন্ত্র দেখছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের প্রতিক্রিয়াও এমনই। এতে ভারত বিষয়ে সরকারের মনোজাগতিক দিক একদম পরিষ্কার।

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় উত্তেজনা-প্রাণহানিতে ভারতের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দুদিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভিকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ- সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের কয়েকদিনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোটামুটি একই ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। আর প্রতিবারই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন এই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি।
ভারতের সেভেন সিস্টার্সের নৈসর্গিক শোভা, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে উত্তাল। সেখানে বাংলাদেশকে টেনে আনাও আরেক বাস্তবতা। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্রকে স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, ‘বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!’ সেই দৃশ্যের ভিডিও প্রবল বেগে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থল-সীমান্ত, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এই সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে! সাতটির মধ্যে চার বোনÑ অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। অসমের ওপর প্রতিবেশী বাংলাদেশের যে একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক লিভারেজ’ বা কৌশলগত সুবিধা আদায়ের পরিসর, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে, ঘটনা ও পরিস্থিতির অনিবার্যতায় পুরনো সেইসব কথা এখন আসছে আবার নতুন করে। আসছে বাংলাদেশের তিন পার্বতী বোনের ইতিহাসে বাইরের উস্কানির কথাও। সেই ইতিহাসের সমান্তরালে ভূগোলের আদ্যোপান্ত মুখস্থ সেনাবাহিনীর। 

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি 
হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

×