ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

পাহাড়ের উত্তেজনায় আমরা শঙ্কিত। গত ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সংঘাত-সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনাগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পার্বত্যাঞ্চল অশান্ত হয়ে উঠুক, সেটা কারোরই কাম্য নয়। পাহাড়ে অশান্তি আপাতত থামলেও, যে ক্ষোভ-ক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি ভবিষ্যতে আরও গভীর হয়, তা হলে সেটি অধিকভাবে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি সেটি সামাল দেওয়া প্রশাসনের জন্য তখন কঠিন হয়ে উঠবে।
ঘটনার জন্য পাহাড়ি ও অভিবাসী দুই পক্ষ থেকে পরস্পরকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ঘটনাটিকে চরম সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে গুজব। সশস্ত্র আক্রমণের গুজব, অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলার গুজব। গুজবে গুজবে হিংসা ছড়ায়। আর জ্বলতে থাকে বাড়িঘর। এরপর মাঠে নামে সেনাবাহিনী। পাহাড়িদের অভিযোগ, অভিবাসীরা সেনাদের প্রশ্রয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাহাড়িদের ওপর গুলি চালায়। সেনাদের অভিযোগ, পাহাড়িরা সশস্ত্র হয়ে সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আত্মরক্ষার্থে সেনারাও গুলি করে। 
পার্বত্য চট্টগ্রামে যা হয়েছে, যা হচ্ছে, এর সমাধান দরকার। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে সরকার বিপুলসংখ্যক সামরিক বাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়ে ছিল। তখন সেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষও হয় একাধিক। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরে তেমন কোনো আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এককথায় বলা যায়, দীর্ঘ তিন দশক ধরে পাহাড়ের সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। 
আমাদের মনে রাখতে হবে, পাহাড় বাংলাদেশের বাইরের কোনো এলাকা নয়। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের সেটেলার বলে এক ধরনের উস্কানি চলে সেখানে। এমনকি অনেক মিডিয়া এবং অ্যাক্টিভিস্ট  নেতিবাচক প্রচার চালায়। পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। পার্বত্য এলাকা যদি বাংলাদেশ ভূখ- হয়, সেখানে যদি কেউ জমি কিনে বসবাস করে তাদের সেটেলার বলা যাবে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ তৈরির বিষয়টি নিঃসন্দেহে উস্কানিমূলক এবং ষড়যন্ত্র। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। নানা ধরনের গুজব রয়েছে। নানা ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে।

পাহাড়িদের নিজের দেশ গঠনের মাধ্যমে তাদের মুক্তি আসবে- এমন চিন্তা ন্যায্য কি না, সেটি খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। অযথা কোনো উস্কানিকে মাথায় নিয়ে সামনে এগোনোর বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাং হতে পারে। কোনো অন্যায্য বিষয়কে ন্যায্য এবং ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি মোটেও শুভ নয়। অযথা ভিন্ন ভিন্ন প্রলোভনে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করার ষড়যন্ত্রে পা রাখা কোনোভাবেই ন্যায্য কিংবা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকদের সবার অধিকার সমান। পাহাড়িদের অবশ্যই সোচ্চার থাকতে হবে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। তারা অবশ্যই তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে। এ বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করাটাই স্বাভাবিক। কোনোভাবেই তাদের প্রতি কোনো বৈষম্য করা যাবে না। মূলত নিজেদের অধিকারের দাবিতে পাহাড়িদের সোচ্চার থাকাই তাদের রাজনীতি হওয়া উচিত। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা এবং যৌক্তিক বিবেচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
সাম্প্রতিক সহিংসতা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সম্পর্ক, সামাজিক সংহতি, শাসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রভাবগুলো মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি-পরিবেশ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনা দুঃখজনকভাবে আগেও অনেক ঘটেছে। বিভিন্ন কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আবার বাঙালিদের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি আস্থার অভাব। ফলে যে কোনো ঘটনায় উভয় সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ নিয়ে দৃঢ় অবস্থানে চলে যায়। স্মরণে রাখা দরকার, বিগত সরকার পতনের পর দেশ এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশে নানা ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বলা যেতে পারে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিরাট এক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নানা ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পার্বত্যাঞ্চলে সৃষ্ট সংঘাত এবং সহিংসতাতেও কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। এ কারণে এ বিষয়টি সরকারকে বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। এ সময় সব পক্ষকে ধৈর্য ধরতে হবে। সরকারকে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি ও বাঙালি দল ও সংগঠনগুলো থেকে দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব আচরণ কাম্য। 
আমরা সকলেই দেশের অখ-তায় বিশ্বাস করি। আমরা অবশ্যই পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নায্য অধিকারের পক্ষে। কাজেই পাহাড়ে বিদ্যমান সকল পক্ষ-বিপক্ষ গোষ্ঠীকে আলোচনায় বসানোর সময় এসেছে। নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হয়, এমন ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সব পাহাড়িকে অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট থেকে দেশের অখ-তার প্রশ্নে ঐকমত্য থাকা উচিত। কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, সকল ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আগামীর দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংঘাতময় উত্তেজনার ধারা থেকে বের হয়ে আসার পথ ও পদ্ধতি অবিলম্বে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের সবার। পাহাড়ে বসবাসকারী সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের শান্তিও বিনষ্ট হবে।


লেখক :  অধ্যাপক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

×