ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রুখবে কে

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রুখবে কে

ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরের রোগ নয়

ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরের রোগ নয়, এটি ইতোমধ্যে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে ডেঙ্গু এখন ঋতুনির্ভর রোগও নয়। সারাবছরের রোগ। এ থেকে সুস্পষ্ট দেশময় সারাবছর আমাদের প্রাণ ঝরাতে যে রোগটি বিস্তার লাভ করছে তা দমনে সকলের কতটা সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিগত বছর গুলোতে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ দিয়ে ডেঙ্গু দমনের চেষ্টা করার ফল এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

কথায় আছে ডেঙ্গু একবার যখন কোনো রাজ্যে বা রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন তাকে আর বের করা যায় না, দমন করে রাখতে হয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন এবং ডেঙ্গুর চিকিৎসা ২টি ভিন্ন বিষয় হলেও একইসুত্রে গাঁথা। সেজন্য দুটি কাজই সমানতালে করা প্রয়োজন। মানুষের প্রাণঘাতী এডিস মশা তার বংশ বিস্তার করে মানুষের শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে চলেছে। ২০২৩ সালে ছিল এই ভয়াবহতা চরমে। যার রেশ ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্তও বীভৎস আকারে ছিল।

২০২৪ সালের মে, জুন মাস একটু স্বস্তি থাকলেও জুলাই হতে আবার তা-ব লীলা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। অনেক বার চেষ্টা করেছি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশক দমনে সকল কার্যক্রম পরিচালনার। কিন্ত সবসময়ই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মশক দমন পদ্ধতি কখনই যেমন একক কোনো পদ্ধতি নয়, তেমনি কখনোই একক কোনো মানুষের সিদ্ধান্ত জোর করে প্রয়োগের বিষয় নয়। এই দমন পদ্ধতি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সকল অংশীজন সমন্বিত পরামর্শের প্রায়োগিক বিষয়।

বিশে^র সকল দেশে মশাবাহিত রোগগুলো সফলভাবে দমনে সক্ষম। সেই দেশগুলোর প্রয়োগিক দিক বিশ্লেষণে আমাদের দেশের পারিপাশির্^ক উপাদানের ভিত্তিতে কতটা ফিজিবল তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে বিপরিত ফলাফল দিতে পারে। যে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ রোগের ক্ষেত্রে ইপিডেমিওলোজিক্যাল স্টাডির যথাযথ বিশ্লেষণে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক পরিসংখ্যান তথ্য উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং তার সঙ্গে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের সঠিক সম্পর্ক নিরূপণ নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সহায়তা প্রয়োজন। মশক দমন পদ্ধতির কার্যকারিতা ও ডেঙ্গুর চিকিৎসার উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে যখন সঠিক গবেষণাভিত্তিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে, কেবল তখনই একটি সঠিক প্রায়োগিক পদ্ধতি নির্বাচন সম্ভব হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা।

আমাদের নগর পিতার কাউন্সিলাররা সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি। এই সাধারণ মানুষের কিসে মঙ্গল তাই তাদের মূল আরাধ্য বিষয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন করে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার ব্রত নিয়েই তারা যেন সেবায় নামেন। কিন্ত বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। দেশে সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যত প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যেমনÑ বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউনেস্কো, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন, ইউএস এইড, প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি নিজস্ব পলিসি রয়েছে।

সেই পলিসির সঙ্গে আমাদের পলিসির সমন্বয় ঘটাতে হলে অবশ্যই গবেষণালব্ধ ফলের ব্যাপকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশের যত গবেষণা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমনÑ জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিপসমের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিশে^র স্বনামধন্য বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ‘এমওইউ’ এর মাধ্যমে যেমন গুণগত মানসম্পন্ন জনস্বাস্থ্যবিদ তৈরি সম্ভব, তেমনি গ্লোবালাইজড এই বিশে^ প্রগতিশীল উদ্ভাবনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতও সম্ভব।

একইভাবে দেশের বিশ^বিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার বৈজ্ঞানিকভিত্তিক পদ্ধতিগুলোই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে। বাড়ানো দরকার গবেষণার পরিধি এবং বাজেটও। দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট তৈরি হয়, তার সঠিক ও সফল ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। আজ জনস্বাস্থ্য প্রায় উপেক্ষিত সঠিকভাবে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে গবেষণা লব্ধ ফলাফলের সঠিক বিস্তার ও প্রয়োগের অভাবে। জনস্বাস্থ্য শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

এটি একটি কমপ্রিহেনসিভ কনসেপ্ট যা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখার সকল শাখা প্রশাখার সমন্বিত একটি বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত মানুষের বসত-বাড়ির অবস্থা অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান থেকে শুরু করে পারিপাশির্^ক অবস্থা। পরিবেশ বিজ্ঞানে পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন রোগ জীবাণুর বাহকের উপস্থিতি ও ঘনত্ব অর্থাৎ এন্টোমোলোজি সেই বাহক কর্তৃক বাহিত রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট প্রভৃতি সংবলিত বিজ্ঞান বা, মাইক্রোবায়োলেজি, মাইকোলোজি, প্যারাসাইটোলোজি, পপুলেশন ডিনামিক্স, এনথ্রেপোলজি, বায়োস্ট্যটিসটিক্স প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে এত বিষয়ের চমৎকার সমন্বয়েই জনগণের সুসাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।

জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুচিকিৎসার জন্য জনবল ও অবকাঠামোর উন্নয়নই হলো স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। এই ধারাবাহিকতা সুসংহত করাই স্বাস্থ্য খাতের মূল উদ্দেশ্য। একজন পুষ্টিহীন মানুষ যেমন কখনই সঠিক ইমিউনিটির অধিকারী হতে পারেন না, তেমনি একজন মানুষ দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে যত ওষুধই সেবন করুন না কেন, অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সুস্থ থাকতে পারেন না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধি করে কখনই একজন মানুষের ডেঙ্গুর হাত হতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব না। তাই দেশময় এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সকলেই আসুন, সম্মিলিতভাবে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে নির্মল পরিবেশে বাস করি।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা

×