.
ফিলিস্তিনের গাজায় গত ৭ অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধের মধ্যেই ইসরাইল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হচ্ছে। এরই মধ্যে গত ১৭ ও ১৮ তারিখে লেবাননসহ সিরিয়ায় পেজার (যোগাযোগ যন্ত্র), ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে বিস্ফোরণের ঘটনায় হিজবুল্লাহর ৩৭ জন নিহত এবং তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। লেবানন সরকার ও হিজবুল্লাহর দাবি, ইসরাইল বৈদ্যুতিক বার্তার মাধ্যমে এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ঘটনাটির পর হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলকে সাজা দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে গোষ্ঠীটির ওপর ইসরাইল সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে। ডিভাইস বিস্ফোরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে ইসরাইল সকল সীমা অতিক্রম করেছে বলে হাসান নাসরুল্লাহ মন্তব্য করেন। টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহ পিছু হটবে না।
কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিস্ফোরণের ঘটনাকে তিনি যুদ্ধাপরাধ বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে তিনি এটাকে ইসরাইলের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা বলেও মন্তব্য করেন। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেবানন এখানেই থামবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, গাজা ও পশ্চিম তীরের মানুষকে লেবাননের প্রতিরোধ বাহিনী সমর্থন দিয়ে যাবে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গত ১৯ তারিখে হিজবুল্লাহর প্রায় ১০০টি রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় নতুন করে হামলা চালিয়েছে। লেবাননের বার্তা সংস্থা ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ১৯ তারিখ সকালে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইল অন্তত ৫২টি হামলা চালিয়েছে।
এর আগে উত্তর ইসরাইলে দেশটির সামরিক স্থাপনাগুলোতে অন্তত ১৭টি হামলা চালিয়েছে বলে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে। ইসরাইলের হামলায় দেশটিতে ৪ জন আহত হয়েছেন বলে লেবানন জানিয়েছে। গত শুক্রবারও দক্ষিণ লেবাননের ৩টি গ্রামে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে। রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণের শহরতলিতে ইসরাইলের ব্যাপক বিমান হামলায় ৩৮ জন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়েছেন। এ হামলায় হিজবুল্লাহর কমান্ডার ইব্রাহিম আকিলও নিহত হয়েছেন। ২১ সেপ্টম্বর ইসরাইলি সামরিক বাহিনী লেবাননে হিজবুল্লাহর বিভিন্ন লক্ষ্যে ৪০০ হামলা চালিয়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বরও হিজবুল্লাহর প্রায় ৩০০ অবস্থান লক্ষ্য করে চালানো হামলায় কমপক্ষে ২৫ শিশুসহ ৪৯২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক মানুষ।
ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বলেছে, তারা দুটি তরঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। একটি প্রায় ২৯০টি সাইট আক্রমণ করেছে এবং দ্বিতীয়টি দক্ষিণ লেবাননজুড়ে ১১০টি সাইটকে আক্রমণ করেছে। এক বিবৃতিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়াল অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ইসরাইলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে হুমকি দূর করতে কয়েক ডজন ইসরাইলি যুদ্ধবিমান দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের ভয়াবহ গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেছেন, দেশের এমন পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ পরিষদে তিনি সফর বাতিল করেছেন। জাতিসংঘকে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইসরাইলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করা কেবল লেবাননের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
লেবাননের বিরুদ্ধে ইসরাইল প্রযুক্তিগত যুদ্ধ চালাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এদিকে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের হাইফা শহরের কাছে রামাত ডেভিড ঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘাত শুরুর পর হিজবুল্লাহ এবং ইসরাইলের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় সংঘাতের ঘটনা বলে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনার পর নিজেদের সৈন্যদের প্রশংসা করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা পর্বে রয়েছি। এখন আমাদের সাহস, সংকল্প ও উদ্যম দরকার।’ তিনি ফলাফল বেশ চমৎকার বলেও উল্লেখ করেন। হিজবুল্লাহর সন্ত্রাসবাদী সক্ষমতা এবং অবকাঠামো ধ্বংস করতে কাজ করছে বলে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী উল্লেখ করে। বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ইরাকের ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স কয়েকটি ড্রোন হামলার দাবি করেছে।
টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, শনিবার রাতে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের জেজরিল উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় শহরে কমপক্ষে ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। অক্টোবরের শুরুতে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি ভূখন্ডে এটি ছিল হিজবুল্লাহর রকেটের গভীরতম অনুপ্রবেশ। আইডিএফ বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দিয়েছে। হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরাইলে ৩ জন আহত হয়েছে। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর শনিবার এক বিবৃতিতে নিজ দেশের নাগরিকদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করায় মার্কিন পরাষ্ট্র দপ্তর দেশটির নাগরিকদের সতর্ক করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, হিজবুল্লাহ এবং ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে এবং বৈরুতসহ লেবাননজুড়ে বিস্ফোরণের কারণে মার্কিন দূতাবাস নিজ দেশের নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।
উভয় দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে হামলার কারণে হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। লেবানন সীমান্তবর্তী নিজেদের উত্তরাঞ্চল থেকে সরিয়ে নেওয়া নাগরিকদের এখন ইসরাইল ফেরত আনতে চায়। তাই অঞ্চলটি নিরাপদ করতে লেবানন সম্প্রতি বিমান হামলা বাড়িয়েছে বলে ইসরাইল দাবি করেছে। গাজা যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত ইসরাইলে হামলা চালাবে বলে হিজবুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছে। হিজবুল্লাহকে একটি ধ্বংসাত্মক বার্তা পাঠানোর জন্য ইসরাইল এ মুহূর্তটিকে বেছে নিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসের মতে, পেজার হামলার পেছনে আসল পরিকল্পনা হলো হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তাদের যোদ্ধাদের পঙ্গু করে দেওয়া।
পরপর দুই দিন লেবাননে একযোগে বিস্ফোরণের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। হিজবুল্লাহর প্রধান মিত্র ইরান সশস্ত্র গোষ্ঠীটির প্রতি সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি বলেছেন, লেবাননে ইসরাইল যে হামলা চালিয়েছে, সেটির বিপর্যয়কর জবাব দেওয়া হবে। পশ্চিমাদের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ইহুদিদের এসব হত্যাযজ্ঞে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা অন্ধভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সকল পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জ্যঁ-পিয়েরে বলেন, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হলে অঞ্চলটির উত্তেজনা কমে যাবে। কিন্তু ইরানের সহায়তাপুষ্ট যেকোনো ধরনের হুমকির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অবিচল রয়েছে বলে জানান। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত কমাতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে।
তারা সমস্যাটির কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ইসরাইলের নিজেদের রক্ষার যে অধিকার রয়েছে, আমরা তার পক্ষে থাকব। তবে এই সংঘাত কোনো পক্ষ বাড়িয়ে দিচ্ছে- আমরা এমনটি দেখতে চাই না। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর থেকে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে অঞ্চলটিতে। মিত্রদের সুরক্ষা দেওয়া এবং নিজেদের ওপর হামলা ঠেকাতে ৪০ হাজার সৈন্য, এক ডজন যুদ্ধজাহাজ ও বিমানবাহিনীর চার স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইল-হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক হামলার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের মুখপাত্র সাবরিনা সিং বলেছেন, এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সৈন্যদের সুরক্ষা দিতে এবং প্রয়োজন পড়লে ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য সক্ষমতা নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী।
গত এক বছর ধরে চলমান দুই পক্ষের এমন সংঘাতকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলা হচ্ছে। এর পূর্বে ২০০৬ সালে ইসরাইল ও ইরানপন্থি হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। তবে গত ১৯ সেপ্টেম্বরের ইসরাইল কর্তৃক পরিচালিত হামলাকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে তীব্র। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ওই দিন বলেছেন, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান তারা চালিয়ে যাবেন। লেবাননে নিযুক্ত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ইউএনআইএফআইএল ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে চলমান এ সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
লেবানন-ইসরইল সীমান্ত ও সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোয় তীব্র লড়াই দেখা গেছে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। ইউএনআইএফআইএল-এর মুখপাত্র আন্দ্রেয়া তেনেন্তি বলেছেন, ব্লু লাইন (ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যকার সীমান্ত) ঘিরে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এমন অবস্থায় আমরা সংঘাত কমাতে সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। লেবাননে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরণের ঘটনার ওপর তাইওয়ানের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তীক্ষè নজর রেখেছে। পেজারগুলো তৈরির সঙ্গে তাইওয়ানভিত্তিক একটি কোম্পানি জড়িত থাকার অভিযোগ আসার পর তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু এমন কথা বলেন। তবে গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানি বলেছে, হামলায় ব্যবহৃত পেজারগুলো তারা তৈরি করেননি। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ওই বিস্ফোরণের জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে হাঙ্গেরিভিত্তিক বিএসি নামের একটি কোম্পানি হিজবুল্লাহকে হাজার হাজার পেজার সরবরাহ করেছিল। বিএসি মূলত একটি ইসরাইলি কোম্পানি বলে নিউইয়র্ক টামসের প্রতিবেদনে এসেছে।
হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহ এক বক্তব্যে মুঠোফোনের ব্যাপক সমালোচনা করে এগুলো ব্যবহারকারীদের ইসরাইলি এজেন্ট বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে পেজার ব্যবহারের ওপর জোর দেন। ফলে, লেবাননে পেজারের চালান উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়। হিজবুল্লাহ ডিভাইসগুলোকে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করলেও, ইসরাইলি গোয়েন্দারা এগুলোকে রিমোট ডেটোনেটর মনে করতেন। উৎপাদন পর্যায়েই ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পেজারগুলোতে পরিবর্তন এনেছিল। এগুলোর মধ্যে ৩ গ্রাম বিস্ফোরক লুকানো থাকলেও হিজবুল্লাহ তা শনাক্ত করতে পারেনি। হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরাইলি ট্র্যাকিং এড়াতে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এগুলো ব্যবহার করেছিল।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, আমরা লেবাননের ওপর এ ধরনের হামলাকে তার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। এটি অপরাধীদের একটি উচ্চপ্রযুক্তির হামলা। যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সশস্ত্র সংঘাত উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, লেবাননে যা ঘটেছে, সেটা যাই হোক না কেন তা অবশ্যই উত্তেজনা বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য নিজেই বিস্ফোরক অবস্থায় রয়েছে এবং এই ধরনের একটি ঘটনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছেন। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিস্ফোরণের ঘটনায় ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয় ছিল। যদিও ওয়াশিংটন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহর মিডিয়া অথরিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসর আল-দিন আমের জানিয়েছেন, তারা প্রয়োজনে লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ আন্দোলনের সহায়তায় গাজার হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা পাঠাতে প্রস্তুত। ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনায় ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীটি হামলা চালিয়ে আসছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, লেবাননে সংঘাতের বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার গুরুতর ঝুঁকি রয়েছে।
এই উত্তেজনা এড়ানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি। এদিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় বিভিন্ন সময় আলোচনা চললেও স্থায়ী কোনো যুদ্ধবিরতি আসেনি। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে। যদিও জাতিসংঘকে ইসরাইলবিরোধী হিসেবে নেতানিয়াহু সমালোচনা করে আসছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকা; হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেন হুতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগ রয়েছে। ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বললেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকারের কথাও তারা তুলে ধরবে সাধারণ পরিষদে। ইরানের প্রেসডিন্টে মাসুদ পেজেশকিয়ান মন্তব্য করেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বৃহত্তর যুদ্ধ বাধাতে চাইছে। যদি মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু হয়, তবে তা বিশ্বের কারও জন্যই লাভজনক হবে না।
এদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আগামী ১২ মাসের মধ্যে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ইসরাইলের অবৈধ উপস্থিতিকে অন্যায় হিসেবে অভিহিত করে অবসানের পক্ষে রায় দিয়েছে। গত ১৮ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে একটি প্রস্তাব বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করেছে। প্রস্তাবটি ১২৪-১৪ ভোটে পাস হয়। ৪৩টি দেশ বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, কানাডা ভোট দানে বিরত থাকে। ইসরাইল ফিলিস্তিনের যে ক্ষতি করেছে, তা পূরণ করার জন্য প্রস্তাবে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অভিমতকেও সমর্থন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্র বিশেষ করে ফ্রান্স, মেক্সিকো, ফিনল্যান্ড প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করতে ইসরাইল বাধ্য না হলেও দেশটির ওপর এটি বেশ চাপ সৃষ্টি করবে। বর্তমান যে যুদ্ধময় পরিস্থিতি, তাতে ইরান ও তুরস্কের পাশাপাশি লেবানন তথা হিজবুল্লাহর সহায়তায় রাশিয়া এমনকি চীনও যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করেছিলেন বিশ্লেষকরা। ইসরাইলবিরোধী শক্তিদের সঙ্গে হিজবুল্লাহ জোট বেঁধে তেল আবিবে সম্মিলিত আক্রমণ চালাতে পারে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেন হুতিদের মতো ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর জড়িয়ে পড়ায় সেই আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। লেবাননে ইসরাইলের সাম্প্রতিক প্রযুক্তি বিস্ফোরণ তথা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই আশঙ্কা বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া এবং হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে লড়াই আরম্ভ হয়েছিল; মধ্যপ্রাচ্যের এমন যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে পরাশক্তিগুলো যুক্ত হয়ে তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করার আশঙ্কা থেকেই যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়