.
মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবচনটি একদা খুব জনপ্রিয় হলেও এখন আর তা বলা যায় না। মূল্যস্ফীতির প্রবল উৎপাতে জীবন যখন যায় যায়, দু’বেলা ভাত-ডাল-শাক জোটানোও দুঃসাধ্য, তখন গরিব ও নিম্নবিত্তদের পাতে ইলিশ মাছ উঠবে সপ্তাহে বা পক্ষে না হোক, অন্তত প্রতিমাসে একদিন, সেটি কল্পনা করাও রীতিমত বিলাসিতা। এর প্রধান কারণ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতা।
সারাদেশে এখন চলছে ইলিশের ভরা মৌসুম। এ সময়ে অন্তত ইলিশ মাছের দাম কমার কথা। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। অবশ্য এর প্রধান কারণ জেলেরা নয়, বরং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। বাজারে ইলিশ বিক্রেতারা প্রতিকেজি ইলিশে মুনাফা করছেন ৭৫০ টাকা ও ততোধিক। রাজধানীর একাধিক বাজারে এর প্রামাণ্য তথ্য পেয়েছেন ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সরেজমিনে অভিযান চালিয়ে তারা দেখেছেন, খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বাজার থেকে প্রতিকেজি ইলিশ এক হাজার ৪৫০ টাকায় কিনে তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন দুই হাজার ২০০ টাকায়। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রবণতা ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম ভোক্তার ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা। তদুপরি প্রতিবেশী দেশ ভারতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মাত্র ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির খবরেই বিক্রেতারা প্রতিকেজি ইলিশের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনশ’ টাকা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে অচিরেই আসছে ইলিশ ধরার ওপর ২২দিনের নিষেধাজ্ঞা। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে গরিব ও মধ্যবিত্তদের পাতে ইলিশের টুকরো উঠবে কিভাবে? পাঠকের মনে রাখতে হবে যে, ইলিশ বিক্রির ওপর সরকারের কোনো করারোপ কিংবা ভ্যাট নেই।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল, এমনকি মৎস্য উৎপাদনেও। চতুর্থ স্থান অধিকারী বাংলাদেশ তবু তো সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে অনেক পিছিয়ে আছে। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের বিপুল অর্থনৈতিক সীমানা থেকে এখন পর্যন্ত খুব কমই মৎস্য সম্পদ আহরিত হয়ে থাকে। আগামীতে এই অফুরান সম্পদ আহরণ করতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে মৎস্য সম্পদে। অবশ্য ইলিশও প্রধানত সামুদ্রিক ও সমুদ্র উপকূলীয় মাছ। মোহনার মাধ্যমে ইলিশ মিঠা পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে থাকে প্রজনন মৌসুমে। আর তখনই ধুম পড়ে যায় জাটকা তথা পোনা ইলিশ আহরণের। যে কোনো মূল্যে এটা বন্ধ করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন বহুগুণ বাড়বে নিঃসন্দেহে।
মনে রাখতে হবে, জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আসে ইলিশ থেকে। আরও একটি শ্লাঘার বিষয় এই যে, ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতিরেকে অন্য ১০টি দেশেই কমেছে ইলিশের উৎপাদন। একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ ভাগই ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। এছাড়াও ২০ থেকে ৯৫ লাখ লোক জড়িত পরিবহন, বিক্রি, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজে। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি অপরিহার্য উপাদান হলো ইলিশ। এর প্রযত্ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব সকলের। দামও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা বাঞ্ছনীয়।