ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্তিম দিনগুলো

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্তিম দিনগুলো

প্রসঙ্গ ইসলাম

(গত শুক্রবারের পর)

নবীজীর (সা.) জীবনের শেষদিকে অসুস্থতার সংবাদ জানার পর হতেই মদিনার আনসারগণ কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছিলেন। নবীজী এটা জানতে পেরে সাহাবাদেরকে ডেকে বললেন, ‘মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আনসারগণ খাদ্যের মধ্যে নিমকের ন্যায় থাকবে। তাদের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে ওটা যেন উপেক্ষা করা হয়। রোগ বৃদ্ধি এবং শরীর ক্রমশ অধিকতর দুর্বল হতে থাকলেও নবীজী (সা.) ১১ দিন নিয়মিতভাবে মসজিদে গিয়েছিলেন। ওফাতের চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবার দিন মাগরিবের নামাজেও তিনি ইমামতি করেন। ইশার নামজেও তিনি শরিক হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পারেননি। শয্যা ছেড়ে যতবার উঠতে চেষ্টা করলেন ততবারই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। 
শেষবার চৈতন্য ফিরে আসলে তিনি বলেন, আবু বকর নামাজ পড়াবে। কিন্তু আবু বকর সে স্থানে হাজির না থাকায় নামাজ পড়াবার জন্য সকলে উমরকে (বা.) অনুরোধ করলেন। কিন্তু নবীজী পরপর তিনবারই বললেন, ‘আবু বকরই নামাজ পড়াবে’। 
আবু বকর (রা.) নামাজ পড়ালেন। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল, পদদ্বয় কাঁপছিল এবং নবীজীর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এরূপ আবু বকর (রা.) মোট ১৭ বেলা নামাজের ইমামতি করেছিলেন। একদিন নবীজী  আবু বকর (রা.) এবং তার পুত্র আবদুর রহমানকে ডেকে এনে একখানি ফরমান লিখাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু উমর (রা.) বললেন, অসুস্থ অবস্থায় নবী কারীমকে (সা.) কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া কুরআন মজিদই যখন রয়েছে তখন আর কিছু বাকি নেই, সব ফয়সালা করা যাবে। নবীজীর ওফাতের দুইদিন পূর্বে  আবু বকর (রা.) জোহরের নামাজ পড়াচ্ছিলেন। এমন সময় নবী কারীম (সা.)-এর মন সেদিকে আকৃষ্ট হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ আলী (রা.) ও আব্বাস (রা.)-এর কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে গমন করেন। মসজিদে তাঁর উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নামাজরত মুসল্লিগণ নবীজীর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে যান। আবু বকরও (রা.)  ইমামের আসন ত্যাগ করতে উদ্যত  হলেন। নবীজী তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করে তারই পাশে নামাজ পড়লেন। 
ওফাতের একদিন পূর্বে নবীজী ৪০ জন গোলাম আজাদ করে দেন। তাঁর ভা-ারে সেদিন সাতটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তিনি বিবি আয়েশাকে (রা.) ডেকে বললেন- ‘দুুনিয়ার ধন-দৌলত ঘরে সঞ্চিত রেখে আমি আমার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব, এটা খুবই লজ্জার কথা। তুমি দীনারগুলো দীন-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দাও।’ 
বিবি আয়েশা (রা.) স্বর্ণমুদ্রাগুলোসহ গৃহের অন্য দ্রব্যসামগ্রীও এমনভাবে দান করে দিয়েছিলেন যে, বাতি জ্বালানোর মতো এতটুকু তেল পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না। সন্ধ্যার পর এক প্রতিবেশীর নিকট হতে তেল ধার করে এনে বাতি জ্বালাতে হয়েছিল। রবিউল আউয়াল মাসের  ৯ তারিখ (মতান্তরে ১২ তারিখ) সোমবার সূর্যোদয়ের পর থেকে নবীজীর চেতনা ঘনঘন লোপ পেতে থাকে। তাঁর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়তে দেখে ফাতিমা (রা.) কাঁদতে লাগলেন।

নবীজী তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, ‘মা তুমি কেঁদ না। আমি চলে  গেলে তোমরা শুধু বলবে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ অতঃপর তিনি ফাতিমার (রা.) পুত্রদ্বয় হজরত হাসান ও হোসাইনকে (রা.) কাছে ডেকে এনে চুম্বন করেন। স্বীয় বিবিগণকেও তিনি সে সময় নানা উপদেশ দান করেছিলেন। 
ক্ষণকাল পরে হজরত আবু বকরের (রা.) পুত্র আবদুর রহমান (রা.) একখ- নতুন মিসওয়াক হাতে সেখানে উপস্থিত হন। নবীজী একদৃষ্টে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নবীজী মিসওয়াক করতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরে বিবি আয়েশা (রা.) তার ভাইয়ের হাত হতে মিসওয়াকখানি নিয়ে ওটার একপ্রান্ত চিবিয়ে নরম করে নবীজীর হাতে দিলেন। হুজুর (সা.) সুস্থ লোকের ন্যায় মিসওয়াক দিয়ে দাঁতগুলো আরও উজ্জ্বল করে নিয়েছিলেন। 
এরপর নবীজী তিনবার হাতখানি ওপরের দিকে উঠিয়ে ক্ষীণস্বরে সেই প্রিয়তম বন্ধুকেই চাই উচ্চারণ করলেন। তৃতীয়বার উচ্চারণের পর তাঁর মুবারক হস্তদ্বয় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। আয়েশা (রা.) তাড়াতাড়ি হুজুর (সা.)-এর মস্তক স্বীয় বক্ষে তুলে নিয়ে তাঁর হস্তপদ আস্তে আস্তে মালিশ করতে লাগলেন। রাসূল (সা.) মৃদু স্বরে বললেন, ‘হাত সরিয়ে নাও।’ মুহূর্তের মধ্যে নবীজীর মুবারক রুহ অনন্তের উদ্দেশে তাঁর দেহ হতে বিদায় নিল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। (২ : ১৫৬)।

পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল মহানবীকে (সা.) স্মরণ ও বরণের মাস। তিনি যে ত্যাগ ও তিতিক্ষা, আদর্শ ও নিষ্ঠা জীবনে প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত করার মধ্যেই প্রকৃত সফলতা। তিনি জীবন সায়াহ্নে ভোলেননি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। ভোলেননি সততার কথা। নিজের প্রচারিত আদর্শকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমল করে দেখিয়ে গেছেন। নামাজের ব্যাপারে, নামাজের জামাত কায়েমের ব্যাপারে এবং অধীনস্থ মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তিনি শেষ জীবনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

আমাদের পরিণত বয়সের জন্য তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো মহৎ আদর্শ হতে পারে। বয়স যতই বাড়–ক না কেন, মৃত্যুর ঝুঁকি যতই কাছে আসুক না কেন আমরা দুনিয়াকে ছাড়তে চাই না। অথচ মহানবী শিক্ষা দিয়ে গেছেন মানুষকে ক্রমাগত আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার, দুনিয়াবিমুখতা অনুশীলনের, তাসবীহ তাহলীল তিলাওয়াত, জিকির আসকার, সালাত ও সালামে একান্তে মনোনিবেশ করার। মাহে রবিউল আউয়াল আমাদের জীবনে হুজুরে আকরামকে (সা.) নতুন করে চেনার ও ভালোবাসার পথ উন্মুক্ত করুকÑ এই কামনা।   (সমাপ্ত)

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও 
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×