ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১

ডেঙ্গুজ্বর- সচেতনতার বিকল্প নেই

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গুজ্বর- সচেতনতার বিকল্প নেই

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত

পরিচিত একজন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এক চিকিৎসা কেন্দ্রে থাকায় তাকে সেখানে দেখতে গিয়েছি। চিকিৎসকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে চিকিৎসক বললেন, সাধারণ জনগণের সচেতনতার জন্য আপনারাও লিখতে পারেন। শুধু চিকিৎসক লিখবে, এমনটা ভাবা উচিত নয়। আজকে যা আলোচনা হলো, তা আপনারাও লিখতে পারেন। এই চিকিৎসকের দেওয়া তথ্য মতে, নিচে লেখার চেষ্টা করলাম।
আমরা এখন ভাগ্যবান। পত্রপত্রিকাসহ নানা প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যতœসহকারে প্রকাশিত হচ্ছে। পঞ্চাশের দশকে একবার এ ধরনের তীব্র জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। সেই ১৯৬৪ সালে ঢাকায় বিশেষ ধরনের জ্বরের প্রকোপ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে ধরা পড়ে। তখন এ জ্বরের কোনো কারণ উদ্ঘাটন করতে না পেরে চিকিৎসকরা ‘ঢাকা ফিভার’ নামে অভিহিত করেছিল বলে জানা যায়। মনে হয় সেই জ্বরটাই আজকের ডেঙ্গুজ্বর। 
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর ও জেলায় আবারও ডেঙ্গুজ্বরের অস্তিত্ব মেলে। সেই থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন মৃত্যুহার ছিল ১ শতাংশ। চিকিৎসকের মতে, ডেঙ্গুজ্বর দুই ধরনের। হেমোরেজিক ডেঙ্গু ও ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু। অনেক সময় ডেঙ্গুজ্বর তীব্র হয়ে ডেঙ্গু হেমোরেজিক শক-সিনড্রোম হতে পারে। চিকিৎসক আরও জানালেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলোÑ ডিইএন-১, ডিইএন-২, ডিইএন-৩, ডিইএন-৪। এ থেকে ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে। ডিইএন-২ ও ডিইএন-৩ নাকি খুবই মারাত্মক। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত নয় এমন এডিস মশা মানুষকে কামড়ালে ডেঙ্গুজ্বর হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৮ থেকে ১১ দিনের মধ্যে এডিস মশা কামড়ের মাধ্যমে মানুষকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে। 
আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনোযোগী নই বলে আসল বিষয় তেমন জানি না। চিকিৎসকরা ডেঙ্গুজ্বর সেরে গেলেও বিপদমুক্ত নয় বলে মতপ্রকাশ করেছেন। ডেঙ্গুজ্বর সেরে গেলে রোগীর প্রতি আরও বেশি যতœশীল হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোমর ব্যথা, হাড় ব্যথা হয়ে থাকে। তীব্র ব্যথার কারণে রোগী অস্থির হয়ে পড়ে। এ সমস্ত সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের জন্য এ জ্বরকে ‘ব্রেক বোন ফিভার’ বলে। চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে, ডেঙ্গুজ্বরের সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। তবে সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুরোধ করা কোনো বিষয় নয়। শুধু জ্বরের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা গেলে কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকে না। 
এ জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে প্রচুর পরিমাণ পানি খেতে হবে। প্রয়োজনে স্যালাইন অপরিহার্য। ধৈর্যের সঙ্গে সব মোকাবিলা করা বুদ্ধিমানের কাজ। চিকিৎসকের দেওয়া তথ্য মতে, হাসপাতালে নিয়ে রোগীর রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট এবং পিসিভি পরীক্ষা করা জরুরি। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরে রোগীর প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে। প্লেটলেট দশ হাজারের নিচে কমে আসলে রোগীকে শিরাপথে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে এবং প্রতিদিন একবার করে প্লেটলেট কাউন্ট পরীক্ষা করতে হবে। যদি রোগীর রক্তক্ষরণ হতে থাকে, তাহলে রোগীকে প্রয়োজন মতো রক্ত দিতে হবে। কারণ, এ সময় রোগীর রক্তবমি, রক্তমিশ্রিত পায়খানা, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণের ফলে রোগী রক্তশূন্যতা হয়ে পড়বে। 
যথাসময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। একবার ডেঙ্গু হলে দ্বিতীয়বার ঐ রোগীর ডেঙ্গু হবে কিনা চিকিৎসকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এ চারটির মধ্যে যে কোনো একটি সেরোটাইপ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে গেলে, ভবিষ্যতে সেই ভাইরাসটিতে আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাকি তিনটি সেরোটাইপ ভাইরাসের যে কোনোটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।  
প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়া যায় যে, এডিস মশা প্রথমে আফ্রিকায় গাছের কোটরে বাস করত। তখন এ মশা বৃষ্টির ঠিক পরপরই গর্তে জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ত। বর্যাকালে এবং অতিরিক্ত আর্দ্র পরিবেশ এডিস মশা বংশ বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযোগী ক্ষণ। বৃষ্টির পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরও এডিস মশার ডিম বেঁচে থাকতে পারে। ডিম ফোটার জন্য এদের আর পানি লাগে না। যে কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরপরই এডিস মশার প্রকোপ কিন্তু বেড়েই চলে। মোটকথা, এডিস মশা বর্যাকালেই বেশি কামড়ায়। 
এডিস মশার বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকা এবং এসব স্থানে বিদেশ থেকে আনা ড্রাম, যে কোনো কনটেনার, আমদানিকৃত টায়ার ও এলাকার আশপাশে পড়ে থাকা টায়ার ইত্যাদিতে এডিস মশা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা একান্ত অপরিহার্য বিষয়। বিশ্বের ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রতিটি দেশেই পারিবারিক এবং কর্মস্থলের বর্জ্য নিষ্কাশন, পয়ঃনিষ্কাশন পদ্ধতির উন্নয়ন এবং প্লাস্টিক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা এসেছে। এডিস মশার প্রকোপ কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায় রয়েছে।
ফলে ডেঙ্গু রোগী দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েকদিনে নানা পত্রপত্রিকা এবং প্রচার মাধ্যমে যা জানা গেল, তা কিন্তু আমাদের জন্য সুসংবাদ নয়। এর থেকে দ্রুত পরিত্রাণ তথা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি স্ব স্ব এলাকার মানুষদের বসতির চারপাশের হাজামজা জলাশয়, জমে থাকা পানি এবং নোংরা স্থান পরিষ্কারে মনোযোগী হতে হবে। কারণ, এডিস মশা দিনে তেমন না কামড়ালেও, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার উৎপাত বেড়ে যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে ডেঙ্গু একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই বিজ্ঞজনের অভিমত হলো, ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় সচেতনতা। আসুন, সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিজে সচেতন হই, অন্যকেও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করি। 
লেখক : সাংবাদিক

×