ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১

কমিয়ে আনতে হবে মূল্যস্ফীতির চাপ

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কমিয়ে আনতে হবে মূল্যস্ফীতির চাপ

তৃতীয় বিশ্বের এই গরিব বাংলাদেশে এখন গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে

তৃতীয় বিশ্বের এই গরিব বাংলাদেশে এখন গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। যদিও বৈশ্বিক গড় মূল্যস্ফীতি এখন ২ দশমিক ৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মূল্যস্ফীতি বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়াকে। যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুত এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়।

যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায়, তখনই মূল্যস্ফীতি ঘটে। এর ফলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আপনাকে আগের চেয়ে বেশি মুদ্রা খরচ করতে হবে। এর মানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে ওই মুদ্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।
সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকলে সেটাকে সহনীয় বলা যায়। ৭ থেকে ১০ শতাংশ হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এর চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে এটা নির্ভর করছে সেই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর। সরকার যদি বিভিন্ন কারণে বেশি করে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে, তাতে বাজারে মুদ্রার আধিক্য দেখা যায়। জিনিসপত্রের জোগান না বাড়ায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়।
একটি দেশের সরকার সাধারণত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করার জন্য বৈদেশিক ঋণ নিয়ে থাকে। সেই মুদ্রা যখন দেশের বাজারে আসে, অন্যদিকে পণ্যের সরবরাহ আগের মতোই থাকে, তখন সেটার প্রভাবেও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে যদি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এবং সে অনুপাতে যদি পণ্যের জোগান না বাড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে দিলে মানুষ প্রচুর ঋণ নিতে শুরু করে। এতে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এতেও মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রি করে কিংবা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ বাড়িয়ে দিয়ে ব্যাংকসৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে আরও নানা উপায় ব্যাংকসৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সরকার কর বাড়িয়ে দিলে কিংবা নতুন নতুন কর আরোপ করলে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমে যাবে।

ফলে,  বাজারে আসা অতিরিক্ত মুদ্রা বেরিয়ে যাবে। এছাড়াও সরকার বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ কমিয়ে অন্যদিকে বাজারে চাহিদামতো পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে উৎপাদনশীল খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
মূল্যস্ফীতির সময় বাজারে দ্রব্যের জোগান বাড়াতে আমদানির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে। এ জন্য মূল্যস্ফীতির সময় সরকার আমদানি শুল্ক কমাতে পারে।

মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি সহনীয় রাখতে তৎপর হলে মূল্যস্ফীতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। সাধারণত কয়েকটি খাত এই মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়। মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষকে ব্যাপক টানাপোড়েনে পড়তে হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেকেই তাদের খরচের লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হন। তবে ব্যবসায়ী ও উৎপাদকগোষ্ঠী এর প্রভাবে লাভবান হয়ে থাকেন।
বাজারে মুদ্রাস্ফীতি যদি অব্যাহত থাকে তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎপাদন না বাড়িয়ে গোপনে পণ্য মজুতের প্রবণতা দেখা যায়। অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্যই তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখে। যে কারণে নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। বাজারে পণ্য ও সেবার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ চাহিদামতো রাখার ওপর জোর দিয়েছেন মিস খাতুন।

এজন্য তিনি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেন বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সরকার পণ্যসামগ্রী ও সেবার সর্বোচ্চ দামের সীমা বেঁধে দিতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও কোনো দেশের জন্যই অতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি ভালো ফল বয়ে আনেনি। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তৎপর থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
মূল্যস্ফীতি জানা গেলে বোঝা যায় যে, কোনো নির্দিষ্ট সেবা বা পণ্যের জন্য আগের তুলনায় একজন মানুষকে কত টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে এবং তা তার জীবনযাত্রার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে। যেমন, একজন ব্যক্তি হয়তো গত বছর কোনো একটি খাবার ১০০ টাকা দিয়ে কিনতেন। ফলে, পাঁচশ’ টাকায় তিনি পাঁচটা খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সেটার দাম হয়েছে ১০৭ টাকা। এখন ওই ব্যক্তির আয়ের কোনো পরিবর্তন না হলে, ৫০০ টাকায় তিনি এখন আর পাঁচটা খাবার কিনতে পারবেন না। তাকে কম কিনতে হবে। এভাবেই মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে।
মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়ি ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মানুষকে এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হন। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সীমিত এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর। কারণ, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক দ্রব্য তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। 
মূল্যস্ফীতি অনেক সময়ে একেকজনের ওপর একেকভাবে প্রভাব ফেলে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে এই চাপ কড়ায়-গ-ায় টের পাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের নানা উদ্যোগও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারছে না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের মধ্যে থাকছে না বা নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। তাদের সংসার চালানোর খরচ অনেক বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে বিবিএসের এই হিসাব সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তা। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি। এক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল, এখনো আছে। গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×