ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১

দৃষ্টিনন্দন ও সুস্বাদু ইলিশ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দৃষ্টিনন্দন ও সুস্বাদু ইলিশ

সুস্বাদু ইলিশ মাছ

চলছে ভাদ্র-আশ্বিন মাসের শরৎকালের অনন্য সময়। রোদ, বৃষ্টির নানামাত্রিক সম্মিলনে সময়টা প্রকৃতিকে বিচিত্রি আবহে মাতিয়ে দেয়। ভাদ্র মাসের তাপপ্রবাহ যেন বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠকেও চোখ রাঙায়। আবার বৃষ্টির ধারায় বর্ষণ¯œাত বাংলাও নতুন রূপ-রসে ভরে ওঠে। সমুদ্র ও নদী পরিবেষ্টিত আবহমান বাংলার যে অবারিত শৌর্য তা কিন্তু মাছে-ভাতে বাঙালির চিরায়ত প্রবাদের নিত্যনতুন অনুরণন।

সত্যিই নৈসর্গ যেন দুই হাত অবারিত করে কোলের সন্তানদের যেভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনায় আগলে রাখে। আর ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্যে তেমন সম্ভার যুগ-যুগান্তরের বরমাল্য বলাই বাহুল্য। ধনে, ধান্যে পুষ্পে ভরাই শুধু নয়, মৎস্যসম্পদেও আমরা এক অনন্য জাতিগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ কাতারে।

স্বয়ম্ভর বাতাবরণে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে রুপালি ইলিশের যে জৌলস তা এ দেশেরই নৈসর্গিক দ্যোতনার অনন্য নির্মাল্য। নির্মাল্যই বটে। সেটা যেমন মাছ ধরা জেলেদের জন্য। সমানভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে দেশীয় খাদ্যপণ্যের নিরন্তর যোগসাজশেও। দৃষ্টিনন্দন, সুস্বাদু ইলিশ যেন নৈসর্গের রানী আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐশ্বর্য।

তেমন সুসময় অতিক্রমের স্বর্ণদ্বারে উপনীত হয়ে ইলিশের যে শুভযাত্রার যুগসন্ধিক্ষণ তাও প্রকৃতিকে নানামাত্রিক উচ্ছ্বাসে আন্দোলিত করছে। আর এই ভোজন রসনার অনন্য ইলিশ আহারের সুষম অসাধারণ খাদ্য। ইলিশকে হৃষ্টপুষ্ট অবস্থায় গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে জেলেদের ভূমিকাও অবিস্মরণীয়Ñঐতিহাসিক।
রুপালি ইলিশ ধরার মৌসুমে সংশ্লিষ্ট জেলেরাও থাকে ব্যস্ত। মাছটিকে যথার্থ সুরক্ষাও দিতে হয় তাদের। সমুদ্র আর নদীর জলরাশিতে ইলিশ মাছের যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য তা বর্তমান আধুনিক যুগকেও নতুন মাত্রা দিতে এগিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। বঙ্গোপসাগরের বিশাল ও সুগভীর পানির ঢেউয়ে ইলিশের যে প্রাপ্যতা তা নিত্য জেলেদের জীবনযাপনের অনবদ্য কর্মদ্যোতনা।

আর খাদ্যরসিক বাঙালিদের প্রতিদিনের উপভোগ্য রসনারও নিয়ামক শক্তি। তবে সেই ইলিশকেই জালে আটকানো থেকে শেষ অবধি সুরক্ষিত রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থাপনাও উপেক্ষণীয় নয়। এই সময়ে ইলিশ মাছ যে মাত্রায় সংশ্লিষ্ট জেলেদের জীবন-জীবিকায় প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে তাও আবহমান বাংলার অনন্য শোভাবর্ধন। তবে আবার এই মাছ ধরা জেলেদেরই খরা মৌসুমে দিনান্তের আহার জোগাড় করতে হিমশিম খাবার দৃশ্যও বেদনাদায়ক। সময়সাপেক্ষ বিষয় তো বটেই।

তার ওপর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত ইলিশ ধরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা সেখানে সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবীদের অলস সময় কাটানোর চিত্রও সুখকর নয়। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে উঠে আসে যখন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত সময়ে তাদের পার করতে হয় অনাহারে-অর্ধাহারে। আইনি ব্যবস্থাপনার সামান্য হেরফের হলে জেল-জরিমানা থেকে মুক্তি না পাওয়াও পরিস্থিতির নির্মমতা। মৎস্যজীবীরাও দিন আনে দিন খায়। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

আর আইন-আদালতের বিষয়গুলো মোকাবিলার সক্ষমতা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেসামাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বশেষ ভোগান্তিও পোহাতে হয়। জাটকা ইলিশ ধরার ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় সেখানে মৎস্যজীবীদের নিয়ে একটি সচেতন ও সুষ্ঠু প্রশিক্ষণও নিতান্ত জরুরি। আধুনিক শিল্প প্রযুক্তির সমৃদ্ধ যুগে সবাইকে বিজ্ঞান প্রশিক্ষণে সাবলীল ও দক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তবে নিরীহ ও পরিশ্রমী মৎস্যজীবীদের আরও সচেতন দায়বদ্ধতা নিতান্ত জরুরি। নদী আর সমুদ্র পাড়ের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা অতি সাধারণ। শিক্ষার আলো থেকেও প্রায় বঞ্চিত। তাই সরকার আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়াও জরুরি। বিশেষ করে ইলিশের ভরা মৌসুমের আগেই জাটকা ধরা থেকে আরম্ভ করে প্রাসঙ্গিক নিয়ম-বিধি আয়ত্তে আনাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা।

সাংগঠনিক নীতি-নৈতিকতাকে সমধিক গুরুত্ব বিবেচনায় মাঠ পর্যায়ে জরুরি কার্যক্রম সম্পৃক্ত করা দরকার। পশ্চাৎপদ, নিরক্ষর অতি সাধারণ মৎস্যজীবীরা যেখানে নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝতেই হিমশিম খায় সেখানে দেশ ও দশের মাঙ্গলিক কার্যক্রম সত্যিই এক দুরূহ বিষয়। ইলিশের প্রজনন থেকে বাজারজাতকরণের পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকে অগণিত জেলে।

সেই মাছের পোনা থেকে শুরু করে তার গঠন বৈচিত্র্যের পরিপুষ্টি সবই প্রাকৃতিক নিয়মে হলেও এক সুসংবদ্ধ পথপরিক্রমাও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যা একটি সুশৃঙ্খল কর্মবিধিতে শেষ অবধি এগিয়ে যায়। তারই ফলে সুস্বাদু, মুখরোচক রূপালি ইলিশ তার যথার্থ মাত্রায় পরিপুষ্ট হয়, যা স্বতঃসিদ্ধভাবে এক নিয়মতান্ত্রিক পথপরিক্রমা। রন্ধনশিল্পের নানারকম কর্মযোগে যা আরও নজরকাড়া হয় স্বাদে আর দৃষ্টিতে। তাই ইলিশকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সুরক্ষিত রাখাও সময়ের অপরিহার্যতা। 
জাতীয় মাছ ইলিশের কদর বিশ্বব্যাপী। আর পান্তা ইলিশ তো গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এক উপাদেয় খাদ্যই নয়, বরং উৎসব আয়োজনেরও অবিমিশ্র ভোজন রসনা। মাছ ধরার সুবর্ণ মৌসুমে ইলিশের যে অবারিত সম্ভার সেটা কিন্তু অতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যা যৌক্তিক কিংবা সঙ্গত নয়। দেশের সিংহভাগ নাগরিকই অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করে।

ধন, ধান্যে পুষ্পে ভরা আর মাছে-ভাতে বাঙালির যে শাশ্বত কর্মসাধনা ও জীবনযাপন সেটাই এই অঞ্চলের চিরস্থায়ী বলয়। যুগ-যুগান্তরের সমৃদ্ধ বাংলা তাই স্বদেশী কবি-সাহিত্যিকদের সৃজনকল্পে আরও মহিমান্বিত হয়েছে। আর ভিন দেশী পরিব্রাজকদের বর্ণনায় সুশোভিত বাংলা আরও নয়নাভিরাম হয়েছে। ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার বলেছেন, এ দেশে প্রবেশ করার বহু পথ আছে; কিন্তু বেরুনোর পথ নেই বললেই চলে। আর কবি জীবনানন্দ দাশ আবেগভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন-
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাই না আর।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
আরো সুললিত কাব্য ঝঙ্কারে
নমো নমো নমো, সুন্দরী মম, জননী বঙ্গভূমি,
পদ্মার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।

চিরায়ত বঙ্গভূমির অপার নান্দনিক শৌর্যের পাশাপাশি মাছে-ভাতে বাঙালির প্রবাদ যেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপের চিরায়ত নৈসর্গিক বৈভব। যেখানে বীজ মাত্রই সোনার ফসল ফলে, যা কবিগুরুর বন্দনা আর অহঙ্কার। তবে ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠাও বঙ্গজননীর আর এক রূপের আধার। অনাবৃষ্টিতে খরা আর অতি বৃষ্টিতে বন্যার ঢল নামাও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংহার মূর্তি। সঙ্গত কারণে সম্মিলিত ভাঙা-গড়ার খেলায় বাঙালিরা এক লড়াকু, সমৃদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর কাতারে।
লেখক : সাংবাদিক

×