ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১

ভবের হাটে ভাবের মানুষ

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:০২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভবের হাটে ভাবের মানুষ

মারুফ রায়হান

পৃথিবীতে ‘নানা রঙের’ মানুষ আছেন; বিচিত্র রঙে রাঙানো তাদের মন। পৃথিবীর কথা থাক, আমাদের দেশের কথাই বলি। সত্যিই এক আশ্চর্য বৈচিত্র্যে ভরা দেশ। ছোট্ট একটি দেশে কত বিচিত্র ভাষাতেই না মানুষ কথা বলেন। বাংলা ভাষার কত রূপ। অথচ দেখুন শুধু রসিকতা করার জন্যেই টিভিনাটকে কোনো কোনো অঞ্চলের ভাষার সংলাপ জুড়ে দেয়া হয়। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলে তার ভাষা বরিশালের হোক, বা নোয়াখালির হোক, সেটি নিয়ে পরিহাস করা চলে না। আমি কি চট্টগ্রামের বা সিলেটের ভাষা বুঝি? বুঝি না, কিন্তু একটু মন দিয়ে শুনলে তার ধ্বনিমাধুর্য কানকে সজাগ করে তোলে। মন্দ লাগে না।

কান বা শ্রুতিকে মধুর আনন্দ দেয় গান। গানের কথায় আসি। সব ধরনের গান সবার ভালো লাগবে না। তাই বলে কি, যে-গান আমার ভালো লাগে না তার গীতিকার বা কণ্ঠশিল্পীদের ওপর আমি হামলে পড়ব? এখানেই সহনশীলতার প্রশ্ন, সভ্যতার প্রশ্নও বটে। এমন লোক আপনি সমাজে ঢের পাবেন যিনি ব্যান্ডগান (তীব্র মেটাল মিউজিক) যেমন শোনেন, তেমনি শোনেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান। লোকগীতিও বাদ থাকে না। আর যিনি সমঝদার শ্রোতা, তিনি তো ইউটিউব হাতড়ে বেড়ান আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার নতুন ধারার গান শুনবেন বলে। এই মুক্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গিই তো মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে। 

রবিবার শহীদ মিনারে যে ফকিরি গানের আসর বসেছিল সশরীরে গিয়ে তা শোনা হয়নি। শুনেছি ফেসবুক লাইভে। নিশ্চয়ই ইউটিউবেও পাওয়া যাবে। কবি ফরহাদ মজহার ছিলেন এই আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা। বহু বছর পর শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত তাঁকে মন্দিরা হাতে মিনার প্রাঙ্গণে ঘুরে ঘুরে গানের সঙ্গে তাল দিতে দেখলাম। নিশ্চয়ই আমার মতো আশির দশকের তরুণদের মনে পড়ে যাবে এই শহীদ মিনারেই সে-সময়ে ক্লিন শেভড ফরহাদ মজহারের নিজের লেখা নিজের সুর করা গান গাওয়ার স্মৃতি এত অন্ধকার আমি কখনো দেখিনি আগে, তাই সাততাড়াতাড়ি যাচ্ছি হেঁটে...। যদিও আমরা অনেকেই জানি না বাংলাদেশে ভাবান্দোলন নিয়ে বই লেখা এই কবি ও চিন্তাবিদ লালন গীতিও গেয়ে থাকেন। আমার একবার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল কুষ্টিয়ায়, লালনতীর্থ ভূমিতেই।

লালনের মাজার সংলগ্ন প্রাঙ্গণে প্রতি বছরই লালন উৎসব হয়ে থাকে। ২০০৭-৮ সালের দিকে একবারই গিয়েছিলাম সেখানে। রাতভর শুনেছি ফকির বাউলদের কণ্ঠে লালনের গান। গভীর রাতে আশেপাশে হাঁটছিলাম। কেউ একজন ফরহাদ মজহারের কথা বললেন। সেখানেই একটা প্রাচীরঘেরা বাড়িতে তিনি আছেন। তখন পর্যন্ত তিনি আমার কাছে কেবল একজন আধুনিক কবি। শ্যামলি থেকে বেশ ভেতরে বারাবো মোহনপুর নামের জায়গাটায় তাঁর ডেরায় গেছি দুয়েকবার। কবিতা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। এবাদতনামা নামে কবিতার বই প্রকাশের পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা আলোচনা সভা হলো। কবি চাইলেন আমি তার বইটি নিয়ে কথা বলি। বলেওছিলাম, পুরোটাই কঠিন সমালোচনা। তাতে কি, সমস্যা হয়নি। কবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবলই কবিতার। সে যাক, ছেঁউড়িয়ায় তাঁর দেখা পাবো ভাবিনি। তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। ভোর হলো। দেখি তিনি মন্দিরা হাতে অন্যান্য বাউলদের সঙ্গে গান গাইতে শুরু করেছেন। বিস্মিত আমি আমার শস্তা ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলে রাখি। তখন দৈনিক যুগান্তরে ছিলাম। সেখানে বড় করে লিখেছিলাম। 

আউল-বাউল ফকিরের দেশে মাজারকে কেন্দ্র করে দর্শনমনস্ক গানপ্রেমীরা গানের অমিয়ধারা পুষ্ট করে থাকেন। আধ্যাত্ম সাধনার পাশাপাশি গানের ভেতর দিয়ে মানবিকতা ও মানবপ্রেমকে উর্ধে তুলে ধরার কাজটি এভাবেই সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। মাজার ঘিরে ফকিরি গানের চর্চা যারা করেন তাদের জীবনধারা নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করতেই পারেন। যেমন লালনের জীবনধারা নিয়েও আছে বিরূপ আলাপন। 

রাষ্ট্রের কোনো নিরাপত্তা বাহিনীতে শতভাগ শৃঙ্খলা বজায়ের চেষ্টা থাকবে, তার শত-হাজার সদস্যের বেশভূষা চুলের ছাঁটসহ জীবনাচার ও সংস্কৃতির মধ্যে সাযুজ্য থাকবে। কিন্তু সৃষ্টিশীল বন্ধনহীন ভাবুকদের অবয়ব তো একরকম হবে না। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে সুসামাজিক সংসারী মানুষের পার্থক্য তো থাকবেই। এখানেই বৈচিত্র্য, এখানেই সৌন্দর্য। সবকিছুতে সমতা আনার জন্য কি তাই বলে মাজারের ফকিরদের ওপরে আমরা আক্রমণ চালাবো? মাজার ভেঙে ফেলবো!

হাজার বছর ধরে এদেশে মাজার সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে আজকের অবয়ব নিয়েছে। সরকার পতনের সাথে সাথে মাজার ভাঙার ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর তাগিদ আসে কোথা থেকে? কোন অধিকারে পির-মুরিদের চিরশয্যাস্থল এবং অন্যদের বসতভূমি ভাঙার প্রয়াস!

কবি ফরহাদ মজহার মাজার ভাঙার প্রতিবাদে গানের হাতিয়ার নিয়ে যে শহীদ মিনারে গেছেন, এটি ব্যতিক্রমী ও সুন্দর। ভবের হাটে ভব্য সুসামাজিক মানুষ যেমন আছেন, তেমনি থাকবেন ভাবের মানুষও। এ দুয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বিভেদ ও দ্বন্দ্ব তখনই আরোপিত হবে যখন বস্তুগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক অভীপ্সা থাকবে। সুরের মানুষের ওপর অসুরের হামলা কখনোই প্রত্যাশিত নয়।

রেকর্ড রাখার প্রয়োজনে এবং ভাবনাকে উস্কে দেয়ার জন্যে ফকিরি গানের আসরে কবি ফরহাদ মজহার যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখান থেকে উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আবারও ফ্যাসিস্ট আক্রমণ হবে, তা আমাদের প্রত্যাশা ছিল না। ইসলামের সঙ্গে মাজার ভাঙার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কেবল বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য।  আমাদের নতুন বাংলাদেশকে যারা নস্যাৎ করতে চায়, মাজারে হামলাকারীরা সে শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের কোনো আলেম-শায়েখ মাজার ভাঙার পক্ষে বলেন না। মতপার্থক্য থাকতে পারে। সবাই একরকম বুঝলে বাংলাদেশে এত ইসলামী রাজনৈতিক দল থাকত না। বিশ্বে এতরকম ইসলামী রাষ্ট্র থাকত না। ফলে আপনারা মুখোশ পরে নাচবেন না। 

কারণ আপনারা সে শক্তি, যাদেরকে তরুণরা লাত্থি দিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। গাঁজা কি কেবল মাজারে খাওয়া হয়? বাংলাদেশের সব বড় বড় হোটেলে গাঁজা খাওয়া হয়। অবৈধ কাজ হয়। তারা কী সেসব ভাঙতে গিয়েছেন! যাননি। কারণ মাজার ভাঙা সহজ। আপনি সহি আর সকলে মিথ্যা; এটা ফ্যাসিস্ট মনোভাব। ফলে যারা মাজার ভাঙছে, তারা একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি। আর আমাদের এখানে পরকাল ব্যবসায়ী আছে, যারা নিজেরা আল্লাহ হয়ে জান্নাত-জাহান্নামের সার্টিফিকেট দেয়।...”


লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]
 

 

শহিদ

×