ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১

ভর্তি নিয়ে ভাবনার শেষ কোথায়

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভর্তি নিয়ে ভাবনার শেষ কোথায়

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৪ লাখের মতো

দেশে এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৪ লাখের মতো। তাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দফায় দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

তবে সাবেক সরকার পতন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এলাকার থানায় হামলা হয়। সেসব থানায় প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা বোর্ড জানায়, ১১ আগস্টের পরিবর্তে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। কিন্তু সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করেছে সরকার।

যদিও পরীক্ষার ফল কিভাবে নির্ধারণ ও প্রকাশ করা হবে সে বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিন জানানো হয়নি। তবে শিক্ষা উপদেষ্টা এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন যে, পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টেস্ট ও প্রি-টেস্টের মূল্যায়ন পত্র নেওয়া হবে। যদিও কিভাবে ফল প্রকাশ করা হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা বোর্ড।

যদি স্থগিত পরীক্ষাগুলোর বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নিয়ে ফল তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সহজ ও সুষ্ঠু উপায়ে মূল্যায়নপত্র প্রদান করে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরীক্ষা কার্যক্রমসহ শিক্ষাঙ্গন দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে। নয়তো তাদের উচ্চ শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষার্থীদের উচিত এখন লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া।
এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল এরই মধ্যে সম্পন্ন হওয়া পরীক্ষা এবং স্থগিত বিষয়ে এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে (ম্যাপিং) এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হোক। কারণ, গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তারা মানসিক চাপের মুখে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত নয়।

এখনো তাদের অনেক সহপাঠী আহত, হাসপাতালে ভর্তি। তাই এ অবস্থায় স্থগিত পরীক্ষাগুলো তারা আর দিতে চায় না। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাড়াও কোনো কোনো শিক্ষাবিদও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত– এ বিচারে স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করেছেন।

কিন্তু বাস্তবে ‘অটোপাস’ কোনো সমাধান হতে পারে না উল্লেখ করে কেউ কেউ বলছেন, স্থগিত পরীক্ষা বাতিল ভবিষ্যতে ২০২৪ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আরও চাপের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে। উচ্চ শিক্ষা, চাকরির বাজারে এ পরিপ্রেক্ষিতে নানা বেগ পোহানোসহ সামাজিকভাবে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এরূপ ঘটনা কোভিডের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না দিয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। সেই সময় এসএসসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের গড় মূল্যায়ন করে ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। বর্তমানে তাদের অটোপাস জেনারেশন নামে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসুবকে যাকে বলা হয় ‘ট্রল’।

যারা পরিশ্রমী শিক্ষার্থী তাদের ওপর এটি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ। এ ম্যাপিং বা অটোপাস পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই অপারগ শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে বাকিদের পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারত। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, অটোপাস দেওয়া হলে শিক্ষার্থীদেরই ভুগতে হয়। তাই কষ্ট করে হলেও পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। সরকারেরও বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়ার দরকার ছিল।

এমনকি পরীক্ষার্থীদের একাংশের মত, এইচএসসির ফল শুধু এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত। কারণ, এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হলে এসএসসিতে খারাপ ফলের কারণে অনেকেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরমই তুলতে পারবে না। তাদের অনেকেই পরীক্ষা হলে হয়তো এইচএসসিতে ভালো ফল করতে পারত।

এরি মধ্যে চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্রের সত্যায়িত ফটোকপিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব পরীক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষদের বোর্ডে পাঠাতে বলা হয়েছে সম্প্রতি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এক বিজ্ঞপ্তি থেকেএসব তথ্য জানা যায়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের আগে এসএসসি পাস করা প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের এসএসসি পাসের নম্বরপত্রের ফটোকপি (সংশ্লিষ্ট বোর্ড যাচাইকৃত) এবং এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪-এর প্রবেশপত্রের ফটোকপি অধ্যক্ষ কর্তৃক সত্যায়ন করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষার্থীদের তালিকা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪-এর সমতুল্য সনদধারী পরীক্ষার্থীদের জেএসসি-সমমান (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও এসএসসি-সমমান পরীক্ষার একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট-নম্বরপত্র (নম্বর/ গ্রেড পদ্ধতির প্রমাণক কাগজপত্রসহ), ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সমতুল্য সনদ এবং এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪-এর প্রবেশপত্রের ফটোকপি অধ্যক্ষের কাছ থেকে সত্যায়ন করে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে অন্য শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বলা হয়, যেসব পরীক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেএসসি-সমমান ও এসএসসি-সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের জেএসসি-সমমান ও এসএসসি-সমমান পরীক্ষার একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট এবং এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪-এর প্রবেশপত্রের ফটোকপি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-অধ্যক্ষের কাছ থেকে সত্যায়ন করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে।

সব পরীক্ষার্থীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি, বিষয় কোড-২৭৫) বিষয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর (শ্রেণি কার্যক্রম চলাকালে প্রাপ্ত) অনলাইনে পাঠিয়ে এর প্রিন্ট কপি কেন্দ্রে সংরক্ষণ করতে হবে এবং মূল কপি (ঋরহধষ পড়ঢ়ু) ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ব্যবহারিক পরীক্ষার অজুহাতে পরীক্ষার্থীদের কলেজে আনা যাবে না।

আরও বলা হয়, অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোয় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক অনুপস্থিত ও বহিষ্কৃত পরীক্ষার্থীদের তালিকা ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে। অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোয় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক স্বাক্ষরলিপি এক কপি কেন্দ্রে সংরক্ষণ করে মূল কপি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শাখায় হাতে হাতে জমা দিতে হবে। 
গত ২০ আগস্ট পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। এখন জেএসসি-এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে মিলিয়ে (ম্যাপিং) ফল প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। সরকার স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি জরিপ পরিচালনা করতে পারত। জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে আহত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যেত।

এ বিকল্প ব্যবস্থা ম্যাপিং ছাড়াও অন্য কিছু হতে পারত। যেমন– সাবজেক্ট ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া। যেটা করোনাকালে করা হয়েছিলÑ শিক্ষার্থীর পড়ালেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। তারপরও দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় ছন্দপতন হয়েছিল। যারা পরবর্তী সময়ে আর সেভাবে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারেনি। তাই পুনরায় এ পথে হাঁটা কতটা যথোচিত তা নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা।

অবশ্য, স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ নিয়ে আরও অনেক আলোচনা ও চিন্তার অবকাশ ছিল– এ কথা শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেছেন। তবে সচিবালয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে। উপরন্তু যেহেতু পরীক্ষা হওয়া ও না- হওয়া এক ধরনের বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি– সে প্রেক্ষাপটে পরীক্ষা না হওয়াটাই সমীচীন বলে মনে করেছে কর্তৃপক্ষ।

উপদেষ্টার এসব কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে কেউ যেন অবমূল্যায়নের শিকার না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা কিভাবে নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে ভাবা উচিত এবং সে মোতাবেক ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করা উচিত। রাজনৈতিক ট্রমা থেকে বেরিয়ে পড়ালেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে শিক্ষার্থীদের।

তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ যাতে ব্যাহত এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে আবারও বিরূপ পরিস্থিতি হলে ম্যাপিং বা অটোপাসের বাইরে আর কী করা যায় সে বিষয়েও প্রস্তুতি রাখা উচিত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা

×