ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাস্থ্যখাতে জনকল্যাণমুখী সংস্কার

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

স্বাস্থ্যখাতে জনকল্যাণমুখী সংস্কার

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

বিগত দিনের গ্লানিভরা স্বাস্থ্যখাত আজ নিবু নিবু করে চলছে। একটা জাতি কখনই রুগ্ন অবস্থায় সম্ভাবনাময় স্বপ্ন দেখতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যেমন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন তেমনি সাহায্যকারী স্টাফও রয়েছেন। সবাইকে নিয়ে স্বাস্থ্যখাত যদি সংস্কার হয় তাহলে একটি অসুস্থ জাতি গঠিত হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত একটি অবহেলিত দুর্বৃত্তায়নের নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে এক দুষ্টচক্রের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে।

বিশেষ করে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বিভিন্ন প্রকার সিন্ডিকেটের অশুভ লিপ্সায় চরম অবস্থায় নিপতিত। সাধারণ অসুখেও দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গকে দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যেতে দেখা যায়। যদি একটি স্বয়ংক্রিয় জনকল্যাণমুখী টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না। মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যকে সমুন্বত করতে হলে ২টি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।

একটি হলো জনস্বাস্থ্য এবং দ্বিতীয়টি হলো সুচিকিৎসা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় প্রথমটি অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য আমাদের দেশে চরমভাবে উপেক্ষিত। যার ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর প্রচ- চাপ পড়েছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড়। এমনকি বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও যেহারে রোগীর প্রেসার ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে তা অবশ্যই অনাকাক্সিক্ষত।

যদি উন্নত দেশগুলোর মতো জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হতো তাহলে চিকিৎসার জন্য নাগরিকের যে অর্থনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার চরম বাস্তবতা তা অনেকাংশে লাঘব হতো। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত নেগলেকটেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ (এনটিডি) গুলো হতে তখনই রক্ষা পাওয়া সম্ভব যখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। একটি উদাহরণ দিলে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

১৮৫৪ সালে যখন ইংল্যান্ডের লন্ডনে ব্রড স্ট্রিটে কলেরা নামক ভয়ানক রোগে ৬১৬ জন জীবন হারান তখন জন¯েœা নামক প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্যবিদ দেখলেন অসুস্থ মানুষগুলো যে পানির উৎস থেকে পানি পান করেছিল সেখান থেকেই এই ভয়ংকর জীবাণু পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তিনি ঐ পানির  উৎসকে অকার্যকর করার মাধ্যমে কলেরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। হ্যাঁ এখানেই জনস্বাস্থ্যের কৃতিত্ব।

তাই জনস্বাস্থ্যকে জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বিগত কোভিড-১৯ এর সময়ও মর্মে-মর্মে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। যেখানে চিকিৎসা সেবা জনস্বাস্থ্যের অত্যন্ত সহায়ক ব্যবস্থাপনা হিসেবে কাজ করবে। নাগরিকের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা ও তার প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করাই আমাদের মতো জনস্বাস্থ্যবিদদের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও শিক্ষার মূল কাজ।

এই কাজের গতি ত্বরান্বিত করার জন্যই প্রয়োজনীয় সংস্কার আশু প্রয়োজন। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে গবেষণার পরিসর বৃদ্ধিকরণ। প্রতিটি জেলা, উপজেলা পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য ইউনিট চালু করা। বর্তমানে এডিস মশার প্রজননকাল চলছে। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৯০৭৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১০৭ জন। একটি মৃত্যুও কাম্য নয়।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন, আচরণ, ভাইরাস ছড়ানোর পদ্ধতি, লার্ভি-সাইড ও এডাল্টিসাইডের প্রতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাসের প্রতিরোধ হয়ে ওঠার মাত্রা, ভাইরাসের  ভিরুলেন্স হয়ে ওঠার মাত্রা প্রভৃতির গবেষণার জন্য উন্নতমানের গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠা নিতান্ত প্রয়োজন। যা বাংলাদেরেশর জনস্বাস্থ্য বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম এ কীটতত্ত্ব বিভাগে প্রতিষ্ঠিত  হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিটিং মিনিটসের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

এখন শুধু প্রয়োজন বাস্তবায়ন। এই মলিকুলার ল্যাব প্রতিষ্ঠা হলে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য তথা ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে অভূতপূর্ব অগ্রগতির দ্বার উন্মোচিত হবে। একইভাবে সংক্রামক ও অসংক্রামক সকল রোগের জন্য ডাটাবেস বা জাতীয় তথ্য ভা-ার সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। নাগরিকের নিজস্ব খরচ স্বাস্থ্যের জন্য প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। এর নিয়ন্ত্রণের জন্য সংস্কার প্রয়োজন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার বিশ^বিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য হতে দেখা যায় ২০১৮ সালে তুলনায় গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ২০২৩ সালে তিনগুণ বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে, মাসিক ১ হাজার ৭০৪ টাকা। তবে এই বর্ধিত স্বাস্থ্যসেবায় খরচ সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক নয়।

ধনী মানুষের মধ্যে এই ব্যয় ছয়গুণ এবং গরিবের মধ্যে তা দ্বিগুণ। গবেষণায় আরও দেখা যায় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে অনেক ওষুধ কোম্পানি তাদের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে অনেকগুণ। এই দামের পরিমাণ ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধ ও রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ও চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খরচ বিপর্যন্ত করেছে নাগরিক জীবনকে।

সংস্কাকারের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত অসহনীয় ব্যয় কমিয়ে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৪০-৫০ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য সকল বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে সরকারকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর রোগের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য উপদেশকৃত প্রেসক্রিপশন যথার্থ নিরীক্ষার মধ্যে রাখতে হবে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী শিশু ও মধ্য-বয়সী, বৃদ্ধদের ডাটাবেস তৈরি করে বারংবার রোগের পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অযাচিত পরীক্ষা ও ওষুধ লেখার প্রবণতা। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দামি মোড়ক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে দামি উপহার প্রদানের অশুভ কালচার। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী খাদ্যবহির্ভূত যে সকল প্রভাবক আমাদের মূল্যম্ফীতির জন্য দায়ী তার মধ্যে প্রধানতম হলো স্বাস্থ্য খাতে নাগরিকের ব্যয়। তাই স্বাস্থ্য অর্থনীতির সংস্কারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সূচকের উন্নয়নই মূল লক্ষ্য। আমরা জানি বিশ^স্বাস্থ্য-সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি ১০০০ জন নাগরিকের জন্য চিকিৎসক মাত্র ০.৬৭ জন এবং নার্স ও মিডওয়াইফারি ০.৪৯ জন। তার ওপর ২৪ শতাংশ পদ শূন্য।

সব মিলিয়ে ডঐঙ এর নির্ধারিত মানদ-ের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কম চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফারি নিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে চলছে আমাদের স্বাস্থ্যখাত। এই খাতকে সংস্কারের জন্য প্রথমেই নজর দেওয়া দরকার জনবলের প্রতি। এর পর বিশেষায়িত চিকিৎসকগণকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী পদায়িত নিশ্চিতকরণ। সুপরিকল্পিতভাবে চিকিৎসাসেবায় জনতুষ্টি আনতে হলে বিশেষায়িত চিকিৎসকের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়া প্রয়োজন হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। 
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের তীব্র সংকট নিয়েই চলছে মেডিক্যাল কলেজগুলো। যার ফলশ্রুতিতে নবীন চিকিৎসকদের তীব্র সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাছাড়া ভূতুড়ে চিকিৎসা খরচ স্বাস্থ্য খাতকে দিন দিন খারাপ থেকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় এসেছে এই ভয়ানক পরিস্থিতি হতে মুক্ত হওয়ার। তাই চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, নার্স, মিডওয়াইফারি সকলের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার আশু প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা

×