ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণে ফিলিস্তিন

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণে ফিলিস্তিন

জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণে ফিলিস্তিন

ফিলিস্তিনের গাজায় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একটি বিদ্যালয়ে ইসরাইলি বিমান হামলায় জাতিসংঘের ছয় কর্মীসহ কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, গাজায় যা হচ্ছে, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মবিষয়ক সংস্থায় কাজ করতেন।

ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গাজায় তাদের বর্বর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে এবং আরও ৪০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ হাজার ১১৮ জনে পৌঁছেছে বলে গত বৃহস্পতিবার অবরুদ্ধ এই ভূখ-ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এই হামলায় আরও অন্তত ৯৫ হাজার ১২৫ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন।

ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে স্পেন, মুসলিম ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মন্ত্রীদের একটি বৈঠকের আয়োজন করেছে। বৈঠকটি গাজার জন্য আরব-ইসলামিক কন্টাক্ট গ্রুপের সদস্যদের একত্রিত করবে। এরমধ্যে মিসর, কাতার, সৌদি আরব এবং তুরস্কের মতো দেশ থাকবে।

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা এবং দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি আন্তর্জাতিক ঐকমত্য তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবে মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকটি।

এদিকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য না হয়েও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ফিলিস্তিন আসন পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করল জাতিসংঘ। যদিও ইসরাইলের জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ফিলিস্তিনকে সদস্যরাষ্ট্রের আসনে বসতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। এর আগে ২০১২ সালে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে ফিলিস্তিন জাতিসংঘে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিল।

এ মর্যাদা প্রাপ্তির পর থেকেই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র পদের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছিল জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি মিশন। বিশেষ করে ২০২৩ সারের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর সেই তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত ১০ মে ফিলিস্তিন স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের পদ পাবে কি নাÑ এই বিষয়ে সাধারণ পরিষদে গণভোট হলে ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৩টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ফিলিস্তিনকে সদস্যরাষ্ট্রের পদ প্রদানের পক্ষে ভোট প্রদান করেন।

তবে পরে আমেরিকা এ প্রস্তাব ভেটোর মাধ্যমে আটকে দেয়। সদস্যরাষ্ট্রের আসনে ফিলিস্তিনি মিসনপ্রধানের বসাকে অবশ্য জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস স্বাগত জানিয়েছেন। এক বার্তায় তিনি বলেন, বিশ^ এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তবে সুসংবাদ হলোÑআমরা ভালো কিছু করতে পেরেছি। 
হিটলারের ইহুদি নিধনের মতোই গাজায় ইসরাইলের হামলাও নিন্দনীয়। ইসরাইলিদের বর্বরতার প্রতিবাদে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, চিলি ও কলম্বিয়া ইসারাইলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। যদিও জর্দান ও বাহারাইন ছাড়া অন্য কোনো আরব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেনি।

হামাস ইসরাইলকে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও জার্মান চ্যান্সেলর তড়িঘড়ি করে ইসরাইলে উপস্থিত হয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এমনকি দেশগুলেঅ অর্থ, অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে ইসরাইলকে সহায়তা করে যাচ্ছে।

ন্যাটোও ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের চরম অভাব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সামরিক ঘাঁটিগুলো মূলত তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণের শক্তি। একমাত্র ইরান ও ইয়েমেন সরাসরি ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করছে। অথচ আরব দেশগুলোর তেল দিয়ে ইসরাইল যুদ্ধবিমান, যুদ্ধযান ও ট্যাংক পরিচালনা করছে।

অথচ মুসলিম বিশে^র সংগঠন ওআইসি শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় শেষ করে। এটি বিশ^ মুসলিম সেন্টিমেন্টকে আহত করার শামিল। ওআইসির অনেক সদস্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের শিকার। ওআইসি তেলের স্যাংশন দিলেই ইসরাইলের চাকা বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু ওআইসি সেটি করছে না। তুরস্ক ও আজারবাইজানের তেলের ওপর ভর করেও ইসরাইল বর্বরতা চালাচ্ছে।

সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তি রয়েছে। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে সৌদি আরব সেই চুক্তি স্থগিত করলেও বাতিল করেনি। ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হওয়ায় তুরস্ক ইসরাইলের ওপর তেলের নিষেধাজ্ঞা দিতে পারছে না। 
বর্তমানে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানকার সমস্যাও প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন সংকটকে বর্তমানে জটিলভাবে দেখা হচ্ছে। জেরুজালেম মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান এই তিন ধর্মের মানুষের নিকট পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। তাই এখানকার সংঘাত কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ নয়, এটি ধর্মযুদ্ধও বটে।

এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি ও জাতীয়তাবাদ অবধারিতভাবে জড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রশক্তির বাইরে এই সংঘাতে শতাব্দীর পর শতাব্দী অরাষ্ট্রীয় শক্তি, রাষ্ট্রীয় জোট, সাম্রাজ্য যুদ্ধ করেছে। এই ইস্যুতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তন হয়নি, এমনকি নিকট অতীতে অনেক প্রভাবশালী দেশের রাজনৈতিক সরকারের পতনও হয়েছে। মানব ইতিহাসে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য এসেছে।

রোমান সাম্রাজ্য থেকে অটোমন সাম্রাজ্য সব সাম্রাজ্যেরই লক্ষ্য ছিল জেরুজালেম ও আল-আকসাকে নিয়ে। ধর্ম ও রাজনীতির বাইরেও ভূমধ্যসাগরের তীরের এই ভূ-খ-টির বাণিজ্যিক ও পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগ তৈরির গুরুত্ব রয়েছে। ফলে বিশ^ মোড়ল হিসেবে আগে ব্রিটিশরা এবং বর্তমানে আমেরিকা অঞ্চলটির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সর্বদাই তৎপর। 
আমেরিকা অতীতের মতো আবারও ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবে। আমেরিকা ইতোমধ্যেই অস্ত্র এবং যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে ইসরাইলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যারা সব সময় যুদ্ধ বাধানোর জন্য সচেষ্ট থাকে, তারাও একটি সুযোগ পেয়ে গেল। কারণ আমেরিকার সামরিক বাজেট কমানোর ব্যাপারে অনেক কথা উঠেছিল।

এখন মিলিটারি বাজেট কমানোর পরিবর্তে আরও বেড়ে যেতে পারে। বিশে^র বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব আমেরিকার অন্যতম মিত্র দেশ। তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটি। ২০২০ সালে আমেরিকার মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরবের প্রতিবেশী আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এছাড়া মরক্কো এবং সুদানও ইসরাইলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করে। আরব বিশে^র অন্য দেশগুলো যেটিকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা হিসেবে বিবেচনা করে। 
উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন হামাসকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। পুতিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন। রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় ঘোষণা দিয়েছে যে, দখলদার ইসরায়েলের আত্মরক্ষার কোনো অধিকার নেই। ইয়েমেনের সশস্ত্র গ্রুপ হুতি এক হাজার মাইল দূর থেকে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে অনেক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল।

সৌদি আরবের আকাশসীমা অতিক্রম করে ইসরাইলকে আঘাত করার নিশানা ছিল। কিন্তু সৌদি আরব মাঝপথে তাদের আকাশসীমায় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। হুতিরা আমেরিকানদের সমুদ্রে ভাসমান ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাক করেও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। কিন্তু সৌদি আরবের আকাশ প্রতিরক্ষা সেগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমেকিানরা ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য তাদের বৃহৎ রণতরীগুলো দিয়ে আরব দেশগুলোকে ঘেরাও করে রেখেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ এবং অবিশ^াসের কারণে ইসরাইল ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তনে সফলতা লাভ করতে পারে। ইতোপূর্বে পাঁচবার ইসরায়েল যুদ্ধ করেছে। প্রতিবারেই সমুদ্রে ভাসমান মার্কিন ক্যান্টনমেন্টের সহায়তায় ইসরায়েল জিতেছে।

আমেরিকা প্রতিবছর ৩.২ বিলিয়ন ডলার ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ন্যাটো গঠন করে পশ্চিমা বিশ^ এবং তাদের মিত্ররা সমগ্র বিশ^ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আরব দেশগুলোর সরকার ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা চায় না। কারণ ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন হলে মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হতে পারে। তেল সম্পদের সিংহভাগ মুসলমানদের হাতে রয়েছে। ন্যাটোর আদলে বিশ^ মুসলিম নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হলে মুসলমানরা হয়তো এমন নির্যাতিত হতো না। ১৯৪৮ সালে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শান্তি তিরোহিত হয়েছে। 
ইরান, সৌদি আরব, মিসর, জর্দান, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে আরব প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। এতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিল ইসরাইল এবং তাকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা ও সামরিকভাবে মদত দিয়ে যাচ্ছিল আমেরিকা। সৌদি আরব, ইরান, আরব আমিরাত এমনকি রাশিয়াও জ¦ালানি সরবরাহের ব্যাপারে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। এই অবস্থায় চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে নতুন পর্যায়ে সমঝোতা এবং সম্পর্ক স্থাপন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের ফলপ্রসূ কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, মিসর, জর্দান ও আমিরাতের মতো পরস্পরবিরোধী আরব রাষ্ট্রগুলো।

তুরস্কের প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে এখন গড়ে উঠছে উন্নত বাণিজ্য ও সামরিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সহযোগিতামূলক প্রকল্প। সৌদি আরব ও আমিরাত তুরস্কের সঙ্গে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যাতে যৌথ উদ্যোগে উৎপাদিত হবে আধুনিক ড্রোনসহ বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্ক তৈরি করছে বিভিন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে রাশিয়া ভূ-কৌশলগত কারণে বিশেষভাবে সহযোগিতা করছে।

এসব কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। গাজার প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও লেবাননের গেরিলা বাহিনী হিজবুল্লাহ ইরানের প্রযুক্তিতে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার। সামনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাছাড়া ইউক্রেনের সার্বিক পরিস্থিতি কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে না। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইহুদিবাদ কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। এটি ইসরাইলের একটি কর্তৃত্ববাদী বিশেষ গোষ্ঠীর বিশ^ব্যাপী প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা আধিপত্য বিস্তারের একটি রাজনৈতিক, সামরিক কৌশল বা মতবাদ। এ বিষয়ে বাধাগ্রস্ত হলে তারা আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় তাঁবেদারদেরও অগ্রাহ্য করতে দ্বিধাবোধ করবে না। তাই ইসরাইলের স্বৈরশাসক বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গণতান্ত্রিক ও মানবিক সব রীতিনীতি কিংবা আদর্শ ভুলে এখন ইহুদি ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে শুরু করেছেন, একদিন তারা সমগ্র বিশে^র ওপর তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।

এক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর অগ্রাধিকার হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের জর্দান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ইসরাইলের সীমানা বর্ধিত করা। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বিভিন্ন অভিযোগে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য ৪ নভেম্বরও রাজধানী তেল আবিবে এক বিরাট প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে।

ইসরাইলের সংবিধান পরিবর্তন করে নেতানিয়াহু তার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিশ^ব্যাপী এই ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণে ইসরাইলের গণতন্ত্রমনা ও শান্তিপ্রিয় মানুষ অবিলম্বে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করে যাচ্ছে। সৌদি আরব-ইসরাইল শান্তি পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। ইরান-সৌদি আরবের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। চীন সেখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছে।

চীনের যে আঞ্চলিক আঁতাতের চেষ্টা, তার গুরুত্ব বেড়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় তার যে জিরো পলিটিক্স, সেটাও অনেক বদলে গেছে। অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে অগ্রাধিকার, তা কিছুটা কমে যাচ্ছিল। আর সেই সুযোগটা চীন গ্রহণ করেছিল। চীন এই গালফের উত্তীর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো করতে শুরু করল, শান্তি স্থাপন করল এবং সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বোঝাপড়ার ব্যপারে একটা ভূমিকা নিতে শুরু করল। চীনের মধ্যস্থতায় এখন ইরান ও সৌদির পুনর্মিলন, এটা আমেরিকার জন্য সুখবর নয়। 
সৌদি আরব এবং আমিরাত আমেরিকার স্যাংশন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে শামিল হয়নি। সৌদি আরব ওপেক ছাড়াও মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছে। ওয়াশিংটনের পরামর্শ সেখানে তারা মানেনি। চীন গালফ এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনের সংঘাতে ভারতের অবস্থান হলো, বৃহৎ শান্তির স্ফটিকে ভারত বিষয়টা দেখতে চায় এবং পশ্চিম এশিয়ায় স্থায়িত্ব চায়।

সেই কারণে পশ্চিম এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র হামাস ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে। ভারত এক্ষেত্রে টু স্টেট সলিউশনের পক্ষে। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হোক, ভারত সেটা চায়। পাশাপাশি যাতে ইসরাইলেও যাতে শান্তি স্থাপিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও ভূরাজনীতির কারণে কখনোই ভূখ-টি স্বীকৃতি পায়নি। সকল প্রকার ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ফিলিস্তিন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক; এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×