ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষকের ঋণ অপরিশোধ্য

বিপ্লব বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২১:২৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিক্ষকের ঋণ অপরিশোধ্য

শিক্ষকতা পেশা হচ্ছে তার অন্যতম

মানুষ মাত্রই কোনো না কোনো গুণের অধিকারী। গুণের রয়েছে নানা শ্রেণিবিন্যাস। গুণবান মানুষ ব্যতীত সমাজ ও দেশ কখনো উন্নত হতে পারে না। শিক্ষকতা পেশা হচ্ছে তার অন্যতম। একজন শিক্ষক মানে সমাজের আলোকবর্তিকা। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকের ঋণ অপরিসীম, অপরিশোধ্য। শিক্ষক শুধু গুরুজন নয়। শিক্ষক মা-বাবার সমতুল্য একজন মহান ব্যক্তিত্ব। পিতা-মাতার পরে যার স্থান তিনি হলেন শিক্ষক।

পিতা-মাতা যেমন সন্তানদের লালন, আদর-¯েœহ, মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রাখেন, ঠিক একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থী তেমনিই। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনোরকম দূরত্ব থাকতে পারবে না। এই দুইয়ের মধ্যে হতে হবে পিতা-পুত্র সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আগের দিনে তেমনিই ছিল; যা আমাদের শিক্ষাজগতকে আনন্দময় করে তুলত। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক জুড়ে আমরা তেমনই দেখেছি।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের পর থেকে এই দুইয়ের মধ্যে ক্রমাগত চির ধরতে শুরু করে। আড়াই দশকের কাছাকাছি সময়ে এসে প্রকাশ্যে শিক্ষকদের নানাভাবে নাজেহাল, লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে খোদ শিক্ষার্থীদের কাছেই। যে বিষয়টি সুধী সমাজকে আহত করেছে। ব্যথিত করেছে পুরো বাংলাদেশকে। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক থাকা উচিত তার একটি উদাহরণ এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই ক্রান্তিলগ্নে আজকে তেমনি একজন শিক্ষকের কথা বলতে চাই, যিনি দারিদ্র্যকে জয় করে মহান শিক্ষকতা পেশায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের পুরস্কার। শিক্ষকতাকে মহান ব্রত হিসেবে নিয়ে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে সন্তান¯েœহে শিক্ষাদান করেছেন। বিনিময়ে লাভ করেছেন অভাবনীয় আত্মসম্মান আত্মমর্যাদা।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্লাসমেট যার সঙ্গে চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসিতে শিক্ষাজীবন কাটিয়েছিলেন, তিনি হলেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বিমল কান্তি বড়–য়া। ১৯৫৭ সালে আইএ-তে তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর মধ্য থেকে মেধাকোটায় সরকারের বৃত্তি লাভ করেন মাত্র দুজন ছাত্র।

তার মধ্যে একজন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যজন শিক্ষক বিমল কান্তি বড়–য়া। প্রফেসর ইউনূসের মাসিক বৃত্তির পরিমাণ ছিল ৩০ টাকা আর বিমল কান্তি  বড়–য়ার বৃত্তির পরিমাণ ২০ টাকা। তা ছাড়াও এই দুইজন অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে সম্পূর্ণ ফ্রিতে পড়ার সুযোগ লাভ করেন।

আইএ সম্পন্ন করার পর তাদের দু’জনের মধ্যে আর তেমন একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বিমল কান্তি বড়–য়া শিক্ষকতার প্রায় অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ সালে লাভ করেন দেশসেরা শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের জাতীয় পুরস্কার। 
সম্প্রতি বিমল কান্তি বড়–য়ার সংস্পর্শে গেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্তমান যে টানাপোড়ন চলছে, তখনকার সময়ের স্মৃতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন তিনি। শিক্ষক বিমল কান্তি বড়–য়া বলেন, ‘শিক্ষকের দুটি মাত্র চোখ নয়। তাঁরা অন্তরে অজ¯্র চোখ দিয়ে দেখেন। তেমনি ছাত্র এবং অভিভাবকদেরও চোখ অনেক। তাঁরাই প্রকৃত বিচারক। তাঁরাই জানেন প্রকৃত শিক্ষক কে।’

বার্ধক্যের সঙ্গে এই প্রবীণ শিক্ষকের জীবনযুদ্ধ চলমান থাকলেও এখনো অসংখ্য ছাত্রের নাম অনর্গল বলতে পারেন। অনেক ছাত্র দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর পরেও স্যারের খোঁজখবর রাখেন সময়-সুযোগে সেই প্রিয় স্যার থেকে দোয়া নিতে বাসায় ছুটে যান। এ এক বিরল ঘটনা! এই গুণী শিক্ষকের অসংখ্য গুণী ছাত্র বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানে নিয়োজিত আছেন। তাদের মধ্যে থেকে প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণ পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরলাম।
ঢাকা জেলার অবসরপ্রাপ্ত দায়রা জজ বিচারক, তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক এত বছরেও স্যারকে ভুলতে পারেননি। সময়-সুযোগে স্যারের বাসায় এসে  দেখা করেন এবং দোয়া নিয়ে যান। তিনি তাঁর ব্যারিস্টার ছেলেকেও তাঁর প্রিয় স্যারকে দর্শন করাতে ঢাকা থেকে নিয়ে আসেন। জীবনে এতটুকু আসার পেছনে স্যারের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।

বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ^জিৎ চৌধুরী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেনÑ স্যার সত্যিকার অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ। শিক্ষক বলতে যে সৌম্য ভাবমূর্তিটি আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে সে রকম একজন মানুষ  বড়–য়া স্যার। কলেজিয়েট স্কুলের মতো সর্বার্থে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক আমাদের পাড়ায় থাকেন, এটা ছিল পুরো এলাকাবাসীর গর্ব।

নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর বিমল স্যার প্রাতঃশাখার ক্লাসে ছাত্রদের আমার পরীক্ষার পুরো খাতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন, যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন এবং সবাইকে এ রকম করে লেখার চেষ্টা করতে বলেছেন। কম বয়সে ছোট ছোট ব্যাপারও অনেক বড় হয়ে ওঠে। এরপর বন্ধুরা আনন্দে-উচ্ছ্বাসে জড়িয়ে ধরেছিল। এভাবে বিমল স্যার একদিন আমার মতো ব্যাক- বেঞ্চারকে সম্মুখ সারিতে টেনে এনেছিলেন।

এই ক্ষুদ্র, কিন্তু আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আজ যখন সামান্য সাহিত্যচর্চা করি, পাঠকের কিঞ্চিত ভালোবাসা পাই, এমনকি বাংলা একাডেমির পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করি, তখনো বিমল স্যারের সেই অবদানের কথা ভুলতে পারি না। 
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক, কবি ডা. হাফিজুল ইসলাম বলেনÑ আমার শিক্ষাজীবনে বড়–য়া স্যার ছিলেন একজন ফেভারিট টিচার। যাঁর কোনো তুলনা চলে না। স্যার চলনে, বলনে, কথনে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান মানুষ। তিনি অনেক বড়মাপের মানুষ। যারা স্যারের সান্নিধ্যে যায়নি তারা এ বিষয়টি কখনো অনুধাবন করতে পারবে না। স্যারের মধ্যে সবসময় ছিল সৃষ্টিশীলতা।

নতুন কিছু জানার, নতুন কিছু শেখার এবং ছাত্রের গড়ে তোলার। স্যারের মেমোরি খুব সার্প। স্যারের বড় গুণ বয়সের নয় দশকে এসেও অসংখ্য ছাত্রের নাম মনে রাখা। তিনি আমার কাছে এখনো ঔজ্জ্বল্য, দেদীপ্যমান।  দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের সম্পাদক রুশো মাহমুদ সময় পেলেই স্যারের শারীরিক খোঁজখবর নিতে ছুটে যান। তিনি বলেন, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানই একজন শিক্ষকের একমাত্র কাজ নয়, এর বাইরেও ছাত্রের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হয়। তার বড় দৃষ্টান্ত বিমল বড়–য়া স্যার।

শিক্ষাদান একটি জটিল ও কঠিন কাজ। একজন শিক্ষক জীবন্ত উপাদান নিয়ে কাজ করেন বলেই শিক্ষকতা অতি উচ্চ পর্যায়ের শিল্প। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, নির্দেশক ও জীবনাদর্শের বাস্তব প্রতীক। আমাদের অনেকেরই শৈশবে এমন একজন আদর্শ শিক্ষকের ছায়া-মায়ায় পল্লবিত হয়েছিল। বড়–য়া স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি, ¯েœহ পেয়েছি আর পেয়েছি আশীর্বাদ।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান চিকিৎসক, নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ধীমান চৌধুরী বলেন, বড়–য়া স্যারের কথা উঠলেই আমার চোখের সামনে সেই এক দীর্ঘ ইতিহাস, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কথা ভেসে উঠে। জীবনের পরতে পরতে স্যার যেন আমার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। আমার কাছে স্যারের গল্প কখনো ফুরোবার নয়।

অষ্টম শ্রেণিতে উঠে স্যারের কাছে প্রথম দিন যখন বাংলা ক্লাস করি, সে এক অদ্ভুত মোহে পড়ে গিয়েছিলাম। বড়–য়া স্যার লাইনের পর লাইন রবীন্দ্র রচনা, কোটেশন কীভাবে দিতে হয়, বাংলা যে একটা মজার জিনিস স্যারের কাছ থেকেই প্রথম জানলাম ও শিখলাম। চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি প্রচুর বাংলা সাহিত্য পড়েছি। এর রসটা তৈরি করে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় বড়ুয়া স্যার। 
বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. শেখ হাছান মামুন বলেন, একজন শিক্ষক কতটুকু হলে অনায়াসে মাথা নুয়ে যায় ছাত্রের; পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার পরম ইচ্ছা জাগে মনেপ্রাণে। তেমনি একজন আদর্শবান শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম ১৯৮৩/১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন বড়ুয়া স্যারকে।

শ্রেণিকক্ষে স্যারকে দেখতাম কর্মোদ্যম ও প্রাণময়তা পরিমিতবোধসম্পন্ন একজন শিক্ষক। অনেক ছাত্রের সামনে পিনপতন নীরবতায় সহজ, সাবলীল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ্য বইয়ের প্রতিটি বিষয় শান্ত মেজাজে পাঠদান করতেন। স্যারের উদ্দীপনা সঞ্চারকারী পাঠে বাংলা ভাষার গদ্যাংশ-পদ্যাংশ এবং ব্যাকারণের জটিল অংশ বুঝতে এতটুকু বেগ পেতে হতো না। পাঠদানের পর যখন প্রশ্নোত্তর পর্ব চলত, সহজে উত্তর দিতে পারায় তাঁর ¯েœহধন্য ও প্রিয় ছাত্রে রূপান্তরিত হলাম।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. সৌমেন সরকার বলেন, সমুদ্রের কথা কি সংক্ষেপে বলা যায়! স্যার হচ্ছেন একটা সমুদ্রের মতো। বাংলার সমুদ্র ছিলেন আমাদের বড়–য়া স্যার। স্যারের কাছেই প্রথম কোনো কবিতা শিখি। শিখি বলা ভুল হবে উপলব্ধি করি। স্যারের ছিল নিজস্ব কবিতার সংজ্ঞা। স্যার চাইলে তখন কোচিং সেন্টার খুলে অনেক ছাত্র পড়াতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।

মঞ্চ অভিনেত্রী কবি আবৃত্তিশিল্পী একাত্তর টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা ফারজানা করিমের প্রিয় স্যারকে নিয়ে অনুভূতি ছিল অন্যরকম। আমি ভাবতে পারছিলাম না, এতবড় এক বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীকে একদিন দেখি আমাদের বাসায় হাজির। ড্রইংরুমে বসে গল্প করছেন আব্বার সঙ্গে। আমি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। খুশিতে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলাম। সময় পেলেই স্যারকে দেখতে ছুটে যাই।

স্যার এখন আর আগের মতো হাঁটতে পারেন না, বার্ধক্য ঘিরে ধরেছে। কানেও তেমন একটা শুনতে পান না। অথচ বার্ধক্যের বেলায়ও স্যারের মনে প্রচ- সাহস, প্রচ- আত্মবিশ্বাস। আদর্শবান মানুষ কখনো ভেঙে পড়েন না, তা স্যারকে দেখেই বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএনসিডিএফ’এর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, কান্ট্রি ফোকাল পয়েন্ট জেসমুল হাসান বলেন, অল্প কয়েকজন শিক্ষক আজকে আমার এই আমিকে গড়ে তুলেছেন।

তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক বড়–য়া স্যার। মাত্র দুই বছরেই জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছেন। অসাধারণ মমতায়, কোমল ন¤্র ব্যবহার দিয়ে পড়াতেন আমাদের। স্যারের কথা এখনো প্রতিনিয়ত স্মরণ করি এবং শারীরিক খোঁজখবর নিই। বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা সেলিম বিন সালেহ বলেন, শান্ত সৌম্য দর্শন, জলদ-গম্ভীর ভরাট কণ্ঠ, জ্যোৎ¯œালোকিত হ্রদের জলের মতো ধীরস্থির তাঁর চলন। স্যার আমি এবং আরও অনেকের কাছে দেবতাতুল্য। স্যারের শারীরিক সুস্থতা কামনা করছি। আসুন, সকল শিক্ষকের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই।
লেখক : সাংবাদিক

×