ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

কৃষক পরিবারের মেয়ে 

কাজী নাজরিন

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কৃষক পরিবারের মেয়ে 

আমি কৃষক পরিবারের মেয়ে, আমার বাবা দাদা সবাই কৃষি কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এটা আমার অহংকার। আমি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে অনেক কিছু শিখতে এবং জানতে পেরেছি। বাংলার কৃষকদের সোনার ফসল ফলানোর পাশাপাশি যে সোনার সন্তান ফলানোর ও ইচ্ছা এবং অদম্য চেষ্টা থাকে আমি তা আমার পরিবারে শিক্ষা লাভ করেছি। আমার পরিবারের সবাই সেই শত বছর আগে হতে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। যে কালে মানুষ স্কুলে যেতে শেখেনি ভালো করে সেই কালে আমাদের কৃষক পরিবারের সন্তান বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি সহ উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন! সেই থেকে আজ অব্দি ধারাবাহিক ভাবে সবাই পড়ালেখার মান ধরে রাখার চেষ্টা করে আসছে।

আমার আব্বা গ্রাম থেকে মেট্রিক পাশ করার পর শহরে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পড়ালেখার এক পর্যায়ে তিন ভাই মিলে চট্টগ্রামে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে তোলেন। এইদিকে আব্বা ডিগ্রী পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম বন্দর ও রেলওয়েতে চাকুরির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু আব্বার ধ্যান ধারণা এবং চিন্তা চেতনায় ছিলো চাকুরী মানে অন্যের গোলামী করা বা অন্যের অধীনে নিজেকে বিসর্জন দেয়া। তাই আব্বা কোন চাকুরীতে যোগদান করেননি। ওইদিকে আমার দাদার বিশাল পরিবার সামলাতে গিয়ে একার পক্ষে অনেক হিমসিম খেতে হচ্ছে। দাদার অনুরোধে আব্বা বাড়িতে চলে যান। আর সংসারের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। এইদিকে আব্বা স্থায়ীভাবে গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশা হিসেবে কৃষিকে বেছে নেন। এরপর শুরু হয় নিজেদের জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, মাছ চাষ ও পশু পালন সংক্রান্ত যাবতীয় সকল কাজ।

আব্বার সংসার, বিয়ে সবই গ্রামে,সেই সূত্রে আমরা ও গ্রামের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। হয়তো আব্বা শহরে চাকুরী করলে আমরা অনেক আরামদায়ক জীবন পেতাম আর গ্রামের কাদামাটির রাস্তায় না হেটে শহরের পাকা রাস্তায় হাটতে পারতাম কিন্তু গ্রামের সেই আন্তরিকতা, সেই ভালবাসা, একসাথে একই পরিবারে সবার সাথে মিলে থাকার বন্ধন, মা চাচিদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইত্যাদি আর খুঁজে পেতাম না! ইট সিমেন্টের সেই শক্ত দেয়ালের মাঝে থেকে সেই স্বার্থপরতাকে হয়তো আপন করে সুখে থাকতে পারতাম। না, আমি চার দেয়ালের এই স্বার্থপরতাকে কোনদিন মন থেকে মেনে নিই না! আমার কাছে মনে হয় আমার আব্বার সেই সিদ্ধান্তই অনেক ভালো ছিল। যার কারণে আমরা সামাজিক, পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে থাকতে পেরেছি। 

আমাদের বড় পরিবারে আমরা এবং আমাদের পরিবারের কাজে সাহায্যকারী সবাই মিলে প্রায় চল্লিশের মতো সদস্য ছিলো, যার মধ্যে মেহমান ছিলো সব সময়। আমাদের পরিবারের এতো মানুষের খাবারের জন্য কোন খাবার বাজার হতে কিনতে হতো না, সবই ছিলো আমাদের ক্ষেত খামার কিংবা প্রজেক্টের। শুধু মাত্র তেল, চিনি আর লবণ ছাড়া সবই আমাদের ঘরের ছিলো!! হঠাৎ করে পনেরো বিশজন মেহমান আসলে মুহুর্তের মধ্যে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা আমাদের পরিবারে ছিলো খুবই সামান্য ব্যপার যা একদম বাজারে না গিয়েই সমাধান করা হতো। যাহা এখন কল্পনা করলে ও কেমন জানি মনে হয়!খাঁটি গরুর দুধ আমাদের পরিবারের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছিলো, যাহা সম্পূর্ণ নিজেদের! চাল,ডাল,মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, সরিষা, ছোলা, লাল আটার গম, ভুট্টা সহ সকল প্রকার সবজি নিজের জমিতেই চাষাবাদ করে এতো মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হত! খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে আবার এইসব কৃষিজ দ্রব্য বাজারে বিক্রি করে পড়ালেখা সহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ করা হতো!! 

আমাদের মেঘনা নদীতে তখন প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যেত আর আমার আব্বা একসাথে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টার মতো কিনে এইসব ইলিশ মাছ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতেন মানুষ জন নিয়ে। বর্ষা মৌসুমের জন্য অনেক খাদ্য সংরক্ষণ করে রাখতেন। মোটকথা আব্বা একদম আন্তরিকতার সাথে কৃষির সাথে যুক্ত সকল কাজ সম্পাদনা করতেন। আব্বাকে দেখতাম মাঝেমধ্যে সি ডি এস পি নামক একটা কৃষি সংস্থার অফিসারকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আর ওই অফিসারের সাথে পরামর্শ করে কম্পোস্ট সার বানিয়ে জমিতে এবং মাছের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। তবে আমাদের একটা দুর্ভাগ্য ছিল এইসব কোন কাজই আমাদেরকে করতে হয় নি। আমাদের যৌথ পরিবারে এতো মানুষের মধ্যে আমাদেরকে রান্নাঘর কিংবা কোন কাজে হাত লাগাতে হতো না। আর আব্বা এইসব একদম পছন্দ করতেন না। আব্বা ছিলেন দাদা দাদুর একদম বিশ্বাস এবং আস্থার! আব্বার কাছে মা বাবাই ছিলো অন্যরকম শ্রদ্ধা ও সম্মানের।আর প্রতিটি সন্তান ছিলো ফুলের মতো। আব্বার ছেলে মেয়ে সবাই এখন শহরেই থাকে। আব্বার শহরে থাকার নিজের বাড়ি ও হয়েছে কিন্তু আব্বা গ্রামে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। শহরে কিছুদিন থাকার পর আব্বা আবার গ্রামেই ফিরে যান।

কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। সেই সাথে সমস্ত কৃষক আমার অনেক অনেক সম্মান এবং শ্রদ্ধার!! সকল কৃষক কে আমি আমার বাবার মতো সম্মান করে যাবো আজীবন। কারণ কৃষকরা ঘামঝরা সোনার ফসলের মতো সোনার সন্তানের ও জন্ম দিয়ে থাকেন। সম্মানিত সকল কৃষকদের অনুরোধ করবো আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার প্রতি একটু গুরুত্ব দিতে হবে।

 

শহিদ

×