ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ

ফাউজিয়া নওয়াল তামান্না

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ

.

এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলমান শতাব্দীর একটি ডিজিটাল ক্ষমতা, যা বুদ্ধিমান প্রাণীর ন্যায় কাজ শিখতে পারে এবং কিছু কাজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নির্ভুলভাবে করতে সক্ষম। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার এই শিক্ষার পরিধি ক্রমেই বাড়ছে এবং মানুষ এই দানবীয় প্রযুক্তির নিকট নিজেকে অর্পণ করছে। রোবট কিংবা কম্পিউটার প্রোগ্রামে চালিত মেশিনারিজের মাধ্যমে হিসাব, পরিসংখ্যান, তথ্য বিশ্লেষণ ইত্যাদি থেকে শুরু করে বর্তমানে উৎপাদনশীল বড় কলকারখানাতেও সহস্র শ্রমিকের পরিবর্তে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে।

দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করায় নিত্যনতুন আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চমকপ্রদ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে এই ডিজিটাল প্রযুক্তিটি। প্রযুক্তির সমৃদ্ধায়নের ফলে গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে আমাদের হাতের মুঠোয় সকল সেবা এনে দেওয়ার  যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা গত শতকে শুরু হয়েছিল, বর্তমান শতকের এই পর্যায়ে এসে এআইর মাধ্যমে যেন পরিপূর্ণতা  পেয়েছে তার শতভাগ। আর এই শতভাগ কর্তৃত্ব এআইর নিকট  ছেড়ে দিয়ে মানুষের আরামপ্রিয় জীবন অন্বেষণের মাধ্যমেই পাওয়া যাচ্ছে ভবিষ্যতের অশনিসংকেত। যা থেকে পরিত্রাণের জন্য এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে দানবীয় এই ডিজিটাল প্রযুক্তির তান্ডবলীলায় বিপন্ন হতে পারে মানব সভ্যতা কিংবা ঘটতে পারে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো কোনো অঘটন।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, এআই কি তাহলে শুধুই অকল্যাণ করে বেড়াবে? আমরা কি এআইকে পরিত্যাগ করে বিজ্ঞানের এই আশ্চর্যজনক উদ্ভাবনের কোনো সুবিধা গ্রহণ করব না? উত্তর হবে- হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই বিজ্ঞানের এই আশ্চর্যজনক উদ্ভাবনের সুবিধা নিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা আরও সহজ আরামদায়ক করে তুলব, তবে তা হবে একটি সীমার মধ্য থেকে। অন্যথায় এটি আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিত। এখন আমরা এআইর কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে মানব সভ্যতার জন্য হতে পারে ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্নের সূচনা।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ, অনলাইনে প্রচার-প্রচারণা জনমত সংগ্রহ, ডাটাবেজ তৈরি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে এআই প্রযুক্তি। কিন্তু এটি কতটুকু নিরাপদ? মানুষ যেহেতু জন্মগতভাবেই বিভিন্ন মতাদর্শে প্রভাবিত, তাই এআই প্রোগ্রামার তাদের মনের অজান্তেই প্রয়োগ ঘটাতে পারে কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন কিংবা অসামঞ্জস্য ডেটার কারণে অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। ফলশ্রুতিতে এআই দ্বারা সৃষ্ট সকল ফলাফলই হতে পারে জন্মগতভাবে একপেশে কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট। জাতি, ধর্ম, বর্ণ কিংবা স্ত্রী-পুরুষের ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখাতে পারে এআই। এছাড়াও অনলাইন ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবীজুড়ে ভুয়া তথ্যের বন্যা বইয়ে দিতে পারে এআই। ব্যবহারকারীর ভাষা কিংবা মনোভাব বুঝতে না পেরেও এআইর মাধ্যমে ছড়িয়ে যেতে পারে বিকৃত কোনো তথ্য কিংবা পক্ষপাতমূলক থিসিস, সাহিত্য, পেইন্টিং, বিভিন্ন শিল্পকলা কিংবা সাংস্কৃতিক উপাদান। বিভ্রান্তিমূলক কর্মকান্ড  বিশ্বাসঘাতকতার সংমিশ্রণে মানুষের বিবেকবোধ তথা ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টিতেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

চ্যাটজিপিটি নামক এআই টুলস যেভাবে মানুষের সকল ডকুমেন্টারি কাজ সম্পন্ন করতে শুরু করেছে এতে করে এই প্রযুক্তির নির্মাতা নিজেই শঙ্কা প্রকাশ করে মার্কিন আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন সর্বগ্রাসী এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য। আমেরিকান রিপাবলিকান সিনেটর জোশ হাওলি এই ভয়াবহ প্রযুক্তিকে পারমাণবিক বোমার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। এআইকে মহামারির মতোই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে শত শত প্রযুক্তিবিদ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিছুদিন পূর্বেসেন্টার ফর এআই সেফটি সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যেখানে সকল প্রযুক্তিবিদ স্বাক্ষর করেছেন। তারা আরও জানিয়েছেন, ‘পারমাণবিক বোমার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার বিলুপ্তি হওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়।

বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত করা বেকারত্বের হার বৃদ্ধির জন্য এখন থেকেই গবেষকরা এআইকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। টেসলা এবং স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ২০২৪ সালের মে মাসে ভিভাটেক সম্মেলনে (প্যারিস) দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন- ‘এআই প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সব ধরনের চাকরি কেড়ে নেবে। মানুষকে ভবিষ্যতে শখের বসে চাকরি করতে হবে এবং সকল সেবা রোবটের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে।এই অবস্থায় আগামী ২০/৩০ বছর পর সকল কর্মস্থানে যখনই এআই অটোমেশনের ফলে দশজন ব্যক্তির কাজ একটিমাত্র রোবটের দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে, তখনই বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দেবে পুঁজিবাদ।

ধনীদের সম্পদ বাড়তে থাকবে এবং গরিবরা হবে আরও গরিব। বিভিন্ন কল-কারখানায় নামমাত্র যে কয়েকজন শ্রমিক থাকবে, তারাও হবে নির্যাতিত। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বাড়বে সকল ক্ষেত্রে। এআইর কারণে বদলাতে হবে বর্তমান পড়াশোনা পদ্ধতিও। ছাত্রছাত্রীদের এক্সাম সিস্টেম পুরোটাই পরিবর্তন করতে হতে পারে এআইনির্ভর বিভিন্ন ডিভাইসের ব্যবহারের ফলে।

এআইর কর্মপদ্ধতি মানুষের নাগালের বাইরে এবং অদৃশ্য থাকার কারণে সেনসেটিভ কাজকর্ম, জরিপ জনমত টাইপের কাজ, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লষণ ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা এবং স্বচ্ছতা বা ট্রান্সপারেন্সির অভাব থেকেই যাবে। যত নির্ভুল ফলাফল আসুক না কেন, এআইর কাজে মানুষের সন্দেহ দূর হবে না। কেননা, এই প্রযুক্তিটি কিভাবে ফলাফল বিশ্লষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে, তা সকলের ধারণার বাইরেই থেকে যায়।

এআইর ওপর অধিক নির্ভরতার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরে আসবে। অকর্মণ্য একটি যুগের সৃষ্টি হবে এবং সকলক্ষেত্রে নজরদারি বৃদ্ধি পাবে। ফেস রিকগনিশনের মাধ্যমে মানুষের নিরাপত্তার চরম অভাব পরিলক্ষিত হবে। খারাপ ডেটার কারণে অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত কিংবা ভিন্নমত দমনের মনোভাব থেকে অপরাধী শনাক্ত অথবা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও এআইর সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক দলের ওপর পক্ষপাতমূলক পুলিশিং হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তবতা হবে প্রচন্ড সাংঘর্ষিক। একজন আরেকজনকে হেয় কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ডিপফেক ভিডিও কিংবা স্থিরচিত্রের ছড়াছড়ি হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক পানি সংকট এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্যও এআইনির্ভর ক্লাউড ডাটা সেন্টারগুলো বড়সড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। প্রচুর পরিমাণে তাপ নির্গমনের কারণে সকল ডাটা সেন্টারসমূহ দ্রুত ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে কোটি কোটি গ্যালন পানি। সামনের দিনগুলোতে দ্রুত সম্প্রসারণশীল প্রযুক্তিপণ্যের সঙ্গে বাড়তে থাকবে শত শত ডাটা সেন্টার। ফলে, জলবায়ু বিপর্যয় পানি সংকটের মতো বিপদের সম্মুখীন হতে হবে পৃথিবীবাসীকে।

সকল প্রকার গোপনীয়তার চূড়ান্ত লঙ্ঘন ঘটবে এআইর বহুমাত্রিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তথ্য চুরি, অর্থ-সম্পদ চুরি, পিন নম্বর হ্যাক করে নিঃস্ব করে দেওয়া, সাইবার হামলার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ, শত্রুতাবশত বিভিন্ন ডাটা সেন্টারে আক্রমণ, একদেশ হতে অন্যদেশে সাইবার হামলা, ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হতে অর্থ স্থানান্তর, ভয়েস ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে কণ্ঠ নকল করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করা, এআই জেনারেটেড বিভিন্ন ছবি তৈরি করে অন্যকে ফাঁসানো, অনলাইন জুয়া, মানিলন্ডারিং অপরাধ এসব কিছুর জন্যই এআইকে প্রতিনিয়ত সাজানো হচ্ছে অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে। আরও আশঙ্কাজনক একটি সত্য যে, ভবিষ্যতে এআইর সর্বাধিক অপব্যবহার হবে সামরিক সেক্টরে। যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রযুক্তিবিদদের ছোঁয়ায় আলাদীনের দৈত্যের ন্যায় আদেশ করা মাত্রই ধ্বংসাত্মক সকল অপকর্ম সম্পাদনের জন্য অপেক্ষমাণ এক গোলাম হিসেবে তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক এই দানবীয় প্রযুক্তি।

এসব কিছু হতে পরিত্রাণের জন্য এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে ওঠার পথ সুপ্রশস্ত রাখতে এখনই হাতে নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ, যাতে করে সর্বনাশা এআই আর একচুল পরিমাণও সামনে এগোতে না পারে এরকম লাগামহীন অবস্থায়। বিশ্বসেরা প্রযুক্তিবিদ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের এক টেবিলে বসে এআই নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক বিধান প্রস্তুত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। কেননা, সময় যত গড়াচ্ছে অপ্রতিরোধ্য এআই ততই শক্তিশালী বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে মানুষের বিপরীতে।

আগামীতে এআই যেন কোনোভাবেই নির্দিষ্ট কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার, কালচার, সামাজিক রীতিনীতি, দর্শন এগুলোকে বাধাগ্রস্ত না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অ্যালগরিদম সেটাপ খুবই সাবধানতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। ডাটা স্টোরেজ ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে অতিরঞ্জন কিংবা ভুলভাল তথ্য বাছাই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সর্বোপরি এআই ব্যবহার করেই এআইকে করতে হবে মানব সভ্যতার জন্য ঝুঁকিমুক্ত। মহামারির পূর্বেই যেমন সঠিকভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে, তা নির্দিষ্ট এলাকার মানব গোষ্ঠীকে নির্মূলে শক্তি সঞ্চার করতে পারে, তদ্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতি বাড়াবাড়ি এখনই বন্ধ করতে না পারলে এটি এক সময় গোটা মানব সভ্যতাকেই নির্মূল করে দেওয়ার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে বলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।

লেখক : শিক্ষার্থী

×