ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

হাওড়ের অপার সৌন্দর্য

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

হাওড়ের অপার সৌন্দর্য

হাওড় মানেই জলে ভাসা জনপদ

হাওড় মানেই জলে ভাসা জনপদ। বছরের প্রায় সাত মাস হাওড় অঞ্চলের গ্রামগুলো জলের ওপর ভাসতে থাকে! তখন সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলোকে দূর থেকে দ্বীপের মতো মনে হয়। বাতাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বর্ষার আদিগন্ত বিস্তৃত থইথই পানি কখনো শান্ত-সৌম্য, আবার কখনো ভয়ংকর রূপ নেয়। যখন দুরন্ত বেগে প্রলয়ংকরী ঝড় আসে, তখন আগ্রাসী হয়ে ওঠে হাওড়।

তছনছ করে দেয় গাছপালা আর গ্রামের পর গ্রাম। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে অনেকটা বুক চিতিয়েই বেঁচেবর্তে থাকে হাওড়ের মানুষ। তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, হাওড়াঞ্চল পূর্বে সাগরের বিশাল জলরাশি ছিল। সাগর আস্তে আস্তে দক্ষিণে সরে গেছে এবং কালের বিবর্তনে তা হাওড়ের রূপ লাভ করেছে। ভাষাবিদগণ ‘হাওড়’কে ‘সাগর’ শব্দের অপভ্রংশ বলে অভিমত প্রদান করেছেন।

‘সাগর’ শব্দ লোকমুখে বিবর্তিত হয়ে ‘হাওড়’ (সাগর>সাওর>হাওর) হয়েছে। বাংলাদেশ যেমন পৃথিবীর সর্বোচ্চ নদীবিধৌত সমতল ভূমির দেশ, তেমনি এদেশে রয়েছে প্লাইস্টোসিনকালের বিভিন্ন গড় অঞ্চল, পাহাড় ও সুবিশাল সমুদ্র উপকূল। বাংলাদেশের ভূবৈচিত্র্যের এক অনন্য স্বতন্ত্র দিক হচ্ছে হাওড়। বাংলাদেশের বিশাল অংশ হাওড় এলাকা হিসেবে পরিচিত।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া অর্থাৎ এই সাত জেলার প্রায় ৮ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওড় অঞ্চল গঠিত, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে ছোট-বড় ৪১৪টি হাওড়, জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে। জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ৬ হাজার ৩০০।

বাংলাদেশে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে হাওড়ের রয়েছে বিশাল প্রভাব। হাওড়পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন হাওড় দ্বারা প্রভাবিত। এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য সব হাওড়কেন্দ্রিক। হাওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়; কিন্তু তা ভাষায় প্রকাশের উপমা দেওয়া বড়ই কঠিন। 

দিগন্ত বিস্তৃত হাওড়ে শনশন বাতাসে সবুজ ফসলে বয়ে যায় অনাবিল ঢেউ। এ যেন সমুদ্রের সৌন্দর্যকেও হার মানায়। আবার বর্ষায় নৌকাগুলোর ছুটে চলার নয়নাভিরাম দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়। জেলেরা মনের আনন্দে মাছ ধরে। হাওড় অঞ্চলে মৌসুমি মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেলা নিত্যদিনের। শরতের সকালে কুয়াশার চাদর, পূর্ণিমার রাতে শাপলা-শালুক সঙ্গে চাঁদের মিতালি, ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির কলতান, দৃষ্টিসীমায় দলবেঁধে উড়ে চলা বলাকার দল, স্বচ্ছ পানিতে সোনালি-রুপালি রঙিন মাছ দেখার মুগ্ধতা, শিল্পীর হাতে আঁকা দ্বীপের মতো বাড়িগুলো- সব মিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি হয় হাওড়-বাঁওড় অঞ্চলে।

আবার কোথাও ধবধবে সাদা কাশফুল, আঁকাবাঁকা সরুপথ গ্রাম্যপথ, শর্ষে ফুলের হলুদে বর্ণমালা, পাকা ধানে উৎসবমুখর কৃষকের কলরব হাওড়াঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে। হাওড়-বাঁওড় অঞ্চল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। পাহাড় থেকে নেমে আসে উজানের পানি। আর তাতেই পলিতে সিক্ত হয় হাওড়-বাঁওড়; বিল পরিবেষ্টিত জলাধার।

জলাধারগুলো নদ-নদীর সঙ্গে মিলেমিশে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করে। মৌসুমে হাওড় অঞ্চলগুলো হয়ে ওঠে ফসলি জমির সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরÑ হাওড়বাসী কৃষকের স্বপ্ন পূরণের প্রধান উৎস। আবার বর্ষা মৌসুমে হাওড়গুলো হয়ে ওঠে সাগরসদৃশ জলরাশির অববাহিকা। কখনও হুট করে পাহাড়ি ঢল, অতিবর্ষণে এবং প্রাকৃতিক বানভাসিতে নিভে যায় কৃষকের স্বপ্ন।

সব সময় মনে হয়, হাওড়ের জীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঝড়ঝঞ্ঝা আর সংগ্রামে পরিপূর্ণ এক মহাকাব্যিক জীবন। তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অসম্ভব। তবু হাওড়াঞ্চলের একজন মানুষ হিসেবে যতটুকু দেখেছি, তার কিছুটা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার চেষ্টা করি মাত্র। একটা সময় ছিল, যখন হাওড়াঞ্চলের মানুষ ছিল একেবারেই কৃষিনির্ভর। শুধু তা-ই নয়, কৃষি ব্যবস্থাটাও ছিল গতানুগতিক।

ফসল ভালো না খারাপ হবে, সেটা নির্ভর করত প্রকৃতির খেয়ালখুশির ওপর। ভাটি এলাকায় বোরো ফসলই ছিল প্রধান। কৃষকরা জমি তৈরি করে ধানের চারা রোপণ করতেন। বিল থেকে দোন (কাঠের তক্তার তৈরি পানি সেচের একপ্রকার সেকেলে যন্ত্র) দিয়ে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতেন।

একপর্যায়ে ফাল্গুন–চৈত্র মাসে বিলও শুকিয়ে যেত। তখন কৃষকদের অসহায়ের মতো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তখন বর্তমান সময়ের মতো সেচের এমন আধুনিক মেশিন ছিল না। 
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই হাওড়ের উৎপত্তি ভূগাঠনিক প্রক্রিয়ায়। মধুপুর সোপান গঠনের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। মেঘনার শাখা নদীসমূহ দ্বারা গঠিত প্লাবনভূমির স্থায়ী ও মৌসুমি হ্রদ নিয়েই গঠিত হয়েছে হাওড় অঞ্চল।

পাহাড়ঘেরা হাওড়গুলো বছরের সাত থেকে আট মাস পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। বাকি সময় এ যেন এক সুবিশাল শ্যামল প্রান্তর। বর্ষায় যে জমিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা হয়, শীতে সেই জমিতে পাকা ধান দোল খায়। হাওড়গুলোর জীববৈচিত্র্য ব্যাপক। একদিকে যেমন প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় মাছ, শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায়, অন্যদিকে স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখি, হাঁস ও অসংখ্য বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল।

এরা একদিকে যেমন হাওড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে মলত্যাগ করে হাওড়ের জলমহালগুলো উর্বর করে। ফলে, হাওড়ে হিজল, করচ, হোগলা, নলখাগড়া, উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন ও লতাগুল্মসহ প্রচুর পরিমাণে জলজ উদ্ভিদ জন্মে। যেখান থেকে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খাদ্য সংগ্রহ করে ও আশ্রয় নেয়। ইকো সিস্টেমের বড় ভূমিকা পালন করে হাওড়ের জীবজগৎ।

শীতে যখন পানি চলে যায়, তখন পশুর চারণভূমি জেগে ওঠে। এ জন্য পশু পালনের জন্য হাওড়বাসীর বাড়তি কোনো ঘাসের জোগান দিতে হয় না। অতি উর্বর পলিমাটির কারণে ধানের ব্যাপক ফলন হয়। হাওড় অঞ্চলের জমিগুলো এক ফসলি। শুধু বোরো ধানই চাষ করা হয়। তবে এখন কিছু কিছু জমিতে কৃষি কর্মকর্তাদের সাহায্য নিয়ে সবজিও চাষ করে। জমিতে বাড়তি কোনো সারের প্রয়োজন পড়ে না।

হাওড়ে তুলনামূলকভাবে ফসল উৎপাদন অনেক বেশি। বর্ষায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি, হাঁস পালন করে হাওড়বাসী। হাওড়বাসী বিনোদনের জন্য বেছে নেয় যাত্রা, পালাগান ইত্যাদি। যার প্রতিরূপ আমরা দেখতে পাই হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রে। শীত মৌসুমে ধানবোনা-ধানকাটা-মাড়াই-শুকানো-বিক্রিতে সময় কেটে যায়। চলে নবান্নের উৎসবও। সুখ-দুঃখ, আনন্দে-উৎসবে কেটে যায় হাওড়বাসীর সাদামাটা সরল জীবন।
হাওড়াঞ্চলকে বাংলার শস্য এবং মৎস্য ভা-ারও বলা হয়ে থাকে। বর্ষায় চারদিক সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি, পালতোলা নৌকা, মন পাগল করা মাতাল হাওয়া, ছোট দ্বীপের মতো করে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো চোখ জুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে। এ সময়ে হাওড়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোরম! শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওড়াঞ্চলে দেশী ও অতিথি পাখ-পাখালির কলতান, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পর মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ ও হলুদ শর্ষে ফুলের দৃশ্যে পরিপূর্ণ হাওড়ের ধু-ধু মাঠ পরিণত হয় এক নয়নাভিরাম ও নৈসর্গিক লীলাভূমিতে।

এ মৌসুমের পড়ন্ত বিকালে মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওড়কে শিল্পীর হাতের সুণিপুণ চিত্রপটের রূপ দেয়। যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে হাওড়। শীত-বর্ষায় হাওড়ের স্বতন্ত্র রূপ প্রকৃতিপ্রেমীদের দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় হাওড়ের মাঠে-ঘাটে-বাঁকে। হাওড়ের জীবন ও প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্যই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশে ধান এবং মাছের চাহিদা পূরণে যুগে যুগে অবদান রেখে আসছে হাওড়। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভা-ার এবং ধান উৎপাদনের বিশাল ক্ষেত্র। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই হাওড়াঞ্চল থেকে। স্বর্ণগর্ভা সোনালি ফসলের মাঠ ও রতœগর্ভা জলমহালের এই হাওড় মৎস্যচাষ আর কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনার দিগন্ত।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওড় নিয়ে হাওড়াঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জ জেলায় ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওড় রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওড়াঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার।

হাওড় এলাকায় হাওড় সৃষ্টির বহু বছর পূর্ব হতেই মানুষজনের বসবাস। বর্তমানে কেউ হাওড় পারের মানুষ। অনেক মানুষ হাওড়ের ভিতরেও বসবাস করেন। এক সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক সমৃদ্ধ জনপদ। মোগল বাদশাহ আকবরের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলার বারভূঁইয়াদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও যোগ্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর যাবতীয় খ্যাতি ও কার্যাবলি হাওড় জনপদেই আবর্তিত ছিল।

ধারণা করা হয়, বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ বিজয় করতে এসে রাজধানী জয় করে পরবর্তী সময় যে অঞ্চলে বিপত্তির সম্মুখীন হন, আর  এগোতে পারেননি, সে অঞ্চলটি হলো  এই হাওড়াঞ্চল; যাকে নি¤œভূমি কিংবা জলাভূমিও বলা হয়ে থাকে। ব্রিটিশরা যে অঞ্চল নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল এবং ইংরেজবিরোধী এখানকার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিদ্রোহ, বিপ্লব ছিল সার্থক।

বাঙালির হাজার বছরের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওড় পারের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প, আনন্দ-বেদনা ও জীবনযাপনের বর্ণিল উৎসব আয়োজন। বাউল গান, সারিগান, জারি গান, বিয়ের গীত, দেহতত্ত্ব, শরিয়তি, মারফতি, মুর্শিদি, মরমি, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, পালাগান, ঘেঁটুগানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গানের বিশাল সম্ভার এই হাওড়াঞ্চলে। হাওড়ের উর্বর মাটির বুকে জন্ম নিয়েছেন বহু সাহিত্যিক, মনীষী।

হাওড়াঞ্চলের অন্যতম বিয়ের আনন্দ হলো লাইট্টা বারি (লাঠি বারি) খেলা। পালকি দিয়ে বউ নিয়ে আসা এখনো দেখা যায় হাওড়ের বুকে। গবেষণা, চর্চা, সংরক্ষণ এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সব কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে।  হাওড়বাসীদের চিত্তবিনোদনের আরেকটা জনপ্রিয় বিষয় ছিল বাউলগান। আগে প্রতিবছর বোরোধান ঘরে তোলার পর প্রতিগ্রামেই বাউলগানের আসর বসত। আসরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ আসত গান উপভোগ করার জন্য। এক আসরে কমপক্ষে দুজন শিল্পী থাকতেন। তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে প্রতিযোগিতা করতেন।

একেকজন একেকটা বিষয় বেছে নিতেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে একে অপরকে প্রশ্ন করতেন। গান আর প্রশ্নবাণের মায়াবী জালে দর্শক-শ্রোতাদের একেবারে সম্মোহিত করে ফেলতেন শিল্পীরা। এমন হতো যে একনাগাড়ে সারাদিন আর সারারাত ধরে চলত এই গান। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাউল শিল্পী জালাল উদ্দিন খাঁ ছিলেন এমনই এক বাউল শিল্পী।

তার লেখা গানগুলোর মধ্যে ‘থাকতে যদি না পাই দেখা চাই না মরিলে’, ‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের অনেক নামকরা শিল্পী এই গানগুলো গেয়ে অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বাউল শিল্পী উকিল মুন্সি বাউল গানের জন্য অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সিনেমায় তার গানগুলো স্থান পাওয়ার ফলে এগুলো এখন সারাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তার বহু গানের মধ্যে ‘শোয়াচান পাখি’, ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে’, ‘সোনা বন্ধুয়া রে এতো দুঃখ দিলে তুই আমারে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম বাউল গানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। 
দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে প্রকৃতিমুখী পর্যটন। যার অন্যতম হাওড়। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে তাই ভ্রমণের অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে অসংখ্য পর্যটক এখন ভিড় জমাচ্ছেন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে।

তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এখন বিলাসবহুল সব নৌকার আনাগোনাও বাড়ছে এ হাওড়ে। আগে বিভিন্ন ঋতুতে চাষবাসের পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ ছিল না হাওড়াঞ্চলে। এখন বর্ষায়ও পর্যটকদের আনাগোনার ফলে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে এখানে। ভাগ্য খুলতে শুরু করেছে হাওড়বাসীর।
বর্ষায় ‘অস্ট্রেলিয়া, শুকনায় নিউজিল্যান্ড’ নামে খ্যাত কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওড় আসলে নান্দনিক সৌন্দর্য আরও বেশি। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের গোধূলিলগ্নের দৃশ্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি ও দর্শনীয় স্থান। জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখির আবাস এই হাওড়ে, যা ইতোমধ্যে দেশীয় পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে।  সমগ্র হাওড়াঞ্চল পর্যটকদের কাছে এক স্বপ্নের ঠিকানাÑজীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তার বিচারে ট্যুরিজমে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। জলের কিনারায় বিশ্বের তাবৎ পর্যটনশিল্প গড়ে ওঠায় পর্যটনশিল্পের প্রাচীনতম ইকো ট্যুরিজম এবং গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নে সর্বোৎকৃষ্ট তীর্থক্ষেত্র এখন হাওড়াঞ্চল। প্রতিনিয়ত আহ্বান করছে অফুরন্ত পর্যটন সম্ভাবনার দুর্নিবার হাতছানিতে। মূলত প্রকৃতি সাজিয়েছে উদার নীড়ে তার সৃষ্টিকে।
    লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, সংস্কৃতিকর্মী

×