ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের করণীয়

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের করণীয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে পাহাড়সম সমস্যা ও বাধা-বিপত্তি

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে পাহাড়সম সমস্যা ও বাধা-বিপত্তি। একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য যা যা করণীয়, তার কোনোটিই এই সরকারের অনুকূলে নেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের  দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসনকালে রাষ্ট্রের সব অনুষঙ্গেই ভয়াবহ পচনের নতুন নতুন সংবাদে নাগরিকরা যারপরনাই বিস্মিত ও চিন্তিত।

যতদূর বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধপরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত এক অবস্থায় আছে। পার্থক্য এতটুকু, তখন পাকিস্তানিরা শোষকশ্রেণি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ভুল করে ১৮ মার্কিন ডলার রেখে গিয়েছিল, এখন ২০২৪ সালে বিবিতে প্রশ্নসাপেক্ষ ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার আছে। সময়ের হিসাব করলে, নানা সূচক যোগ-বিয়োগ করলে রিজার্ভের অবস্থা সম্ভবত আরও খারাপ অবস্থায় আছে।

তারপরও জনগণের সীমাহীন এই সরকারের প্রতি  প্রত্যাশা।  এমনই এক প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কী করণীয়, তা নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। সবারই মত, অর্থনীতিতে আমূল পরির্বতন আনতে হবে। অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার সাধন করতে হবে। তবে সবার আগে মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের মৌলিক কিছু সমস্যায় প্রথম নজর দিতে হবে। এসব সমস্যা নিয়ে নির্মোহ অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই পরামর্শ দিয়েছেন, বলে আসছেন।

সেসব পরামর্শ হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের ‘কথিত উপকারকারী’ গোষ্ঠী ও মানুষের ‘বিরোধী’ খোঁজার মহা এক উৎসবের আড়ালে চলে গেছে। তাই সরকারকে সাবধানে, সবদিক পর্যালোচনা করে এগোতে হবে। এ জন্য সর্বাগ্রে নীতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে অর্থনীতির মূল খাত ও ক্ষেত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষণ পরিচালনা করতে হবে, যা সরকার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ  ক্রিয়াকলাপের অবস্থার মূল্যায়ন করবে, দুর্বলতা ও ব্যর্থতা চিহ্নিত করবে। অর্থাৎ সমস্যার মূলগুলো নথিভুক্ত করে প্রকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আশুপরিবর্তনগুলো সারিবদ্ধ করে, সে অনুযায়ী প্রতিকারের কাজ শুরু করতে হবে। 
গত কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই তলানিতে। গত জুলাইয়ে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপরে আছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার  গেড়ে বসা সংস্কৃতি থেকে বের হতে ক্ষমতার বলয়ে থাকা একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের এখনো তীব্র অনীহা দেখা যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদেরই কেউ কেউ এখন শিল্প বাঁচানোর স্বার্থে সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনার হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের বিন্দুমাত্র বিবেক থাকলে মনে রাখা দরকার, পতিত সরকারের দেড় দশকের খেলাপিঋণ নিয়ে সরকারের লুকিয়ে-ছাপিয়ে প্রকাশ করা তথ্যেই দেখা গেছে খেলাপিঋণ  বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ কোটি টাকা। মূলত ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া ও লুটপাটের বিষয়ে চোখ বন্ধ করার নীতি নেওয়ার কারণে খেলাপিঋণ বেড়েছে।

এই লুটপাটে এই ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিলেন। ব্যাংক খাতের নীতিনির্ধারণে  ক্ষমতার বলয়ে থেকে তারা হেন অপকর্ম নেই যে করেননি। মাতৃভূমির করুণ অবস্থায়, বিশেষত শত শত কিশোর-তরুণের তাজা প্রাণের অকালে হত্যাকা-ের শিকার হতে দেখে লুটপাটকারী ব্যবসায়ী শ্রেণির একটু মনুষ্যত্বের প্রকাশ দেখানো উচিত।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, ডলারের তীব্র সংকট চলছে, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট আর বিদেশে দেদার অর্থপাচার অর্থনীতিকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। পতিত সরকারের লোকজনের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের যে চিত্র প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে যেকোনো মানুষকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অর্থনীতির একটি ভালো চেহারা দেখানোর চেষ্টা এখন হাতেকলমে প্রকাশ পাচ্ছে।

জনজীবনের সর্বত্র অস্বস্তি দৃশ্যমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এখনো সাধারণ মানুষ রীতিমতো পিষ্ট অবস্থায়। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে বিদায় নেওয়া পতিত সরকার বলা যায় ধ্বংস করে গেছে দেশের অর্থনীতি। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন করার কারণে বিগত সরকার দেদার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ, যা বর্তমান বাজেটের ৩ গুণের সমান।

হরেদরে এবং যেভাবে পেরেছে সেভাবেই দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে জাতীয় বাজেটের ভারসাম্যই নষ্ট করা হয়েছে। ফলে, বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। এদিকে ডলারের সংকট এখনো চলমান। ৮৬ টাকার ডলার ১২০ টাকায় উঠেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লেও তা এখনো প্রয়োজনীয় রকম না। অর্থনীতির আকার অনুসারে পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি অর্থনীতিকে অভেদ্য এক চক্রে ফেলে দিয়েছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে জনগণকে অভয় দিতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি, যা শিল্প খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশের অস্থিরতায় ইন্ধন দিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে।

তার ওপর দেশের অভ্যন্তরে বাজারঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, শুধু খেলোয়াড়ের বদল ঘটেছে। তাই দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, তা যদি আপাত শোভন মনে না-ও হয়। কারণ, অর্থনীতির ক্ষেত্রে পতিত সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল সংকট নিরসনে সময় মতো ব্যবস্থা না নেওয়া, অর্থনৈতিক সংস্কারের অনীহা; সেহেতু বর্তমান সরকারকে অর্থনীতির জন্য আশুপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো বাধ্য হয়ে নিতে হবে। জনগণ যেহেতু এই সরকারের সঙ্গে আছে, সেহেতু সরকারকে কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখানোর প্রয়োজন আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১ মাস পরের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতায় থেকেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধে পতিত সরকার যেসব উদ্যোগ নিতে পারেনি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার ৩০ দিনের মধ্যেই সেসব উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে শ্বেতপত্র প্রণয়নে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।  অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, আর্থিক খাতে এই বার্তা দেওয়া গেছে যে, অনিয়ম-দুর্নীতি করে এবং ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকে ব্যাংক দখল করে দেদার ঋণ নেওয়ার দিন গত হয়েছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি বার্তাও এসেছে অর্থনীতিবিষয়ক নেতৃত্বের কাছ থেকে। সরকারের এসব উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানতে অর্থনীতির অত্যাবশ্যকীয় সূূচকের প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ায়।

দেশে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে পতিত সরকারের সৃষ্ট ঘটনাবহুল জুলাই মাসে। আর এই তথ্য জানা গেছে সরকার পতনের পর আগস্ট মাসে। মূল্যস্ফীতিসহ সরকারের হাজির করা নানা পরিসংখ্যানের সত্যতা ও ন্যায্যতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলেন। সব পণ্য ও সেবার দাম হু হু করে বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হারকে দুই অঙ্কের ঘর পার হতে দেখা যায়নি। করোনার কারণে পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি খারাপ হওয়ার কথা জানা গেলেও বাংলাদেশের সরকারকে প্রবৃদ্ধি বাড়তি প্রবণতা হাজির করতে দেখা গেছে, যা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে হাস্যরসের পাত্র করে দিয়েছিল।

আর এখন দেখা যাচ্ছে, আগস্টে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতিসহ সব হিসাবে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।  নানাবিধ চাপ থাকলেও সময় মতো রাষ্ট্রের জন্য অতিজরুরি প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ না করার কাজে লিপ্ত সরকারের প্রশাসনযন্ত্রকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যেতে, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য-পরিসংখ্যান হালনাগাদ হতে থাকে।

কারণ, সরকারের কার্যকর নীতি প্রণয়নের জন্য প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত জানা দরকার। সরকারের অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের পর পরিসংখ্যান তথ্য-উপাত্ত যাতে হালনাগাদ করে প্রকাশ করা যায়, সেজন্য উন্নত বিশ্বের কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা নিতে হবে।  
পরিশেষে বলা যায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থে কী করণীয়, তা বোঝা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে সরকারের কৌশলগত ও নীতি পরিকল্পনাকারীদের নতুন দৃষ্টান্তের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। যেহেতু দেশকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেহেতু বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান অর্থনৈতিক মডেলগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

৪০ বছর আগে চীন ছিল পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু দেশটি পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ক্ষয়-লয় হিসাব নিকাশ করে স্বদেশ-উত্থিত এক নীতি প্রণয়ন করেছে। বাধ্য হয়ে চীনের বিদ্যুৎচালিত গাড়িসহ নানা পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের অপ্রতিরোধ্য গতি রোধে চেষ্টা করছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক নীতি দেশটিকে আলো দেখাচ্ছে। চীনের এই অবস্থাকে অনেকেই ঐতিহ্যগত পুঁজিবাদ থেকে সামাজিক পুঁজিবাদ, সবুজ পুঁজিবাদ বা স্টেকহোল্ডার পুঁজিবাদের মতো নতুন একটি মডেল বলে মনে করছেন।

ডক্টর ইউনূসের সামাজিক ও সবুজ পুঁজিবাদেরও একটি দর্শন আছে, তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দের সবাই বলা যায় নির্মোহ। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সামগ্রিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে ভিন্নভাবে কিছু ভাবতে হবে। তাদের এই প্রচেষ্টা সফল না ব্যর্থ তা সময়ই বলে দেবে। 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, 
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×