ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

সংস্কারের নিয়ামক পথনির্দেশ

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সংস্কারের নিয়ামক পথনির্দেশ

কোটা সংস্কার থেকে ভেতরের হরেক সংস্কারে নতুন মাত্রা

কোটা সংস্কার থেকে ভেতরের হরেক সংস্কারে নতুন মাত্রা দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যাতে পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে নানামাত্রিক অসঙ্গতি, বেপরোয়া দুর্নীতি, স্বাধীন মত প্রকাশে রুদ্ধতার জাল বিস্তার সবই ধরা পড়ে। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, অত্যাচার, অবিচারের দুঃসহ পালাক্রমে জাতির যে অনাবশ্যক ঘন অন্ধকার তাও এক প্রকার নিঃশব্দ, চাপা দাবানল।

সাধারণ নাগরিকের অন্তর্নিহিত বোধে যে চাপা বিক্ষোভ, মর্মান্তিক দুঃসহ কালযাপন যেন দীর্ঘ অপশাসনের পালাক্রমের এক কঠিন বাতাবরণ। আনুষ্ঠানিক-প্রাতিষ্ঠানিক আপাত দৃশ্যমান নতুন অবয়ব সেটা কিন্তু বাহ্যিক এক রদবদল। মূল ব্যবস্থাপনায় হরেক ব্যবচ্ছেদের নতুন মাত্রা সময়সাপেক্ষ তো বটেই। তার ওপর দীর্ঘ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আর বেসামাল পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তাও ভেবে দেখার সময়।

দেশটা চলছে নতুন পরিস্থিতির পালাক্রমে নবতর এক গঠন প্রক্রিয়ায়। যা সমাজ-সভ্যতার নিয়ম হলেও অস্থিরতার নানামাত্রিক পর্যায়। সেটা যেমন শিক্ষা কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনার আর এক অনধিগম্য কালপর্ব। অসাম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট যখন আধুনিক ও নতুন প্রজন্ম তাদের অবস্থান থেকে নিজের পরিচিতি জানান দেয় তা জাতির জন্য অহঙ্কার আর গৌরবের বিষয়।

তবে শিক্ষা পাঠক্রমে যাদের সম্পৃক্ত থাকা নিতান্ত জরুরি, সেখানে যদি অন্যবিধ সমস্যার পথ পাড়ি দিতে হয়, তাতে শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েন। মেধা ও মননের তীর্থস্থান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি জাতি গড়ার কারিগরদের নতুন ব্যবস্থাপনার অনুবর্তী করতে পারে, তবেই জাতির জন্য তা মঙ্গলজনক। 
সমুদ্র পরিবেষ্টিত আর নদী¯œাত আবহমান বাংলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ। নানামাত্রিক প্রাকৃতিক সংহারকে সামাল দিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এক লড়াকু জাতিগোষ্ঠী বাঙালি। তারপরও ধন ধান্য, পুষ্পে ভরা বাংলার নৈসর্গিক সম্ভার সর্বজনবিদিত ও ঐতিহাসিক। নরম উর্বর পলিমাটির এই অঞ্চলে নাকি বীজ ফেললেই সোনার ফসল ফলে।

প্রতিদিনের যাপিত জীবনের অভাবনীয় ঐশ্বর্যম-িত এক অনন্য পালাবদল। সৃজন আর ধ্বংসের মহামিলনে চিরায়ত বাংলা তার আপন বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান। ষড়ঋতুর বিচিত্র নীলাখেলায় সমৃদ্ধ এই বদ্বীপ। বিভিন্ন ঋতুতে সময়মতো প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হচ্ছে না বলে নিসর্গ বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুলছেন সেই গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই।

প্রকৃতি যদি তার যথার্থ চেহারা সময়-অসময়ে পাল্টাতে থাকে সেটা কোলের সন্তানের জন্য মঙ্গল কিংবা সুখকর হয় না। তাই আমাদের এখনকার জলবায়ু বিপন্নতা সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের চরম বিপরীত প্রতিক্রিয়া। অত্যধিক দাহ্য শিল্পজ্বালানি বাতাসে যে কার্বন নিঃসরণ করে, তাতে প্রকৃতি তার সহজাত অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায়।

সবুজ গাছপালা, বন-বনান্তর যে মাত্রায় বাতাসে অক্সিজেন ছড়ায়, তাও প্রাকৃতিক ভারসাম্যতার নিয়ামক শক্তি। সেখানেও চলছে অবধারিত কর্তন। নগরায়ণ আর শহরকেন্দ্রিক অত্যাধুনিক বিশ্ব যে মাত্রায় বন-বনান্তর উজাড় করে বহুতল ভবন আর শিল্প-কারখানা নির্মাণ করে যাচ্ছে, তাতে পরিবেশ হচ্ছে ভয়াবহ উষ্ণতার এক মারাত্মক দুরবস্থার শিকার। গ্রীষ্মকালে চরম দাবানলের পাশাপাশি বর্ষণ¯œাত মুখরিত বাদর দিনেরও এক সিক্ত আবহ।

সব মিলিয়ে প্রকৃতি যখন বিপন্ন পরিস্থিতির চরম শিকারে পতিত হয় তখন কোলের সন্তানদের সমূহ বিপর্যয়ও ঠেকানো মুশকিল। খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলবায়ু দূষণে যে লাগাতার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, তাতে দেশের সামগ্রিক অব্যবস্থারও এক চরম দুঃসময়। এ তো গেল প্রকৃতির কাছে অসহায় আবহমান বাংলার অতি সাধারণ মানুষের বিপন্নতার হরেক চিত্র।

ফলে সেই সাধারণ মানুষকেই সর্বনাশার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। কিছুদিন আগে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কবলে ভাসমান জনগোষ্ঠীর দুঃসহ জীবনের করুণ কাহিনী গণমাধ্যমের খবর হয়েছে। সেখানে যদি সচেতন মানুষই সামাজিক বিপন্নতাকে দৃশ্যমান করে তোলে, তার দাম যে কত কঠিনভাবে দিতে হবে তেমন চিত্রও আমাদের বিচলিত করে।

সম্প্রতি তেমন অসহনীয় দুঃসংবাদও সবাইকে হতবাক করে দেয়। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও অনেক কিছু বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশও ঐতিহ্যিক কিছু সম্ভার বিদেশে রপ্তানি করে। তা ছাড়া মাছে ভাতে বাঙালি মৎস্য শিল্পেও এক সমৃদ্ধ জাতি। রূপালি ইলিশ, বাগদা, গলদা চিংড়ি, বড় সামুদ্রিক মাছ চাহিদামতো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মহাসংযোগ।

তা ছাড়াও পাট, পাটজাত দ্রব্য, বয়ন শিল্প, পোশাক শিল্প থেকে চা শিল্পেরও বিদেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা আমাদের বিনিয়োগ অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার অনন্য যাত্রাপথের অংশীদার ও অঙ্গীকারে বাংলাদেশের খ্যাতি বিশ্বসভায় দৃশ্যমান, স্বীকৃত। অবকাঠামো আর প্রাকৃতিক বৈভবে সমৃদ্ধ আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। নৈসর্গিক ঐশ্বর্য যেমন দেশটার অবারিত নয়নাভিরাম চিত্র পাশাপাশি হরেক বিপন্নতাও চেপে বসার দুঃসহ দৃশ্য উপেক্ষা করার মতো নয়।

প্রাকৃতিক সংহার আর বৈপরীত্যে নানামাত্রিক দুর্দশাও জনগোষ্ঠীকে কাবু করতে যেন মুখিয়ে থাকে। উন্নত প্রযুক্তির সুফল যত না বর্তায় বাংলাদেশের ওপর, তার চেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বিপন্ন পরিস্থিতির কোপানলে পড়া। আমরা এখন শরৎকালের ¯িœগ্ধ আবহের মাস অতিক্রম করছি। তার মধ্যেই চলছে লাগাতার বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারা। প্রতি মুহূর্তে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে বর্ষণের প্লাবনে সিক্ত বানভাসি মানুষের চরম দুঃসময়।

সমুদ্রনগরী কক্সবাজারে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি। তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য পাহাড় ধসে চরম আকাল। গত ৭৬ বছরে এমন বৃষ্টি দেখা যায়নি বলে তথ্যসূত্রে প্রকাশ। মৃত্যুর সংখ্যাও বিচলিত হওয়ার মতোই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঘনঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত দেশের অনেক অংশ। রাজধানী ঢাকাও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। বিগত কয়েক বছরের বিক্ষিপ্ত উন্নয়নের লাগাতার অসামঞ্জস্যতায় পানি জমে যাওয়াও পরিস্থিতির দুর্বিপাক।

প্রকৃতির বিরূপ ঝাপটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে তেমন দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করছে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হলে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র চলে যেতে হয়। সেটা অতি অবশ্যই নিরাপদ কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেও স্বস্তি-শান্তি কোনোটাই মেলে না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ। সেখানেও দেখা যায় হরেক অনিয়ম আর বিপন্নতা।

বিশেষ করে জমে থাকা পানির দীর্ঘ পথ পার হয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আরও এক মহাবিড়ম্বনা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দুঃসহ কাল অতিক্রম করছে। যা ঋতু বৈচিত্র্যকেও যেন উপহাসের মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
নতুন রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সামনে এগিয়ে চলাও অন্য এক চ্যালেঞ্জ। লাগাতার ১৬ বছরের ক্ষমতার দাপট আর দম্ভে দেশের যে নয়ছয় দুরবস্থা ক্রমান্বয়ে তা সামনে চলে আসাও চরম দুঃখজনক। একদিকে প্রকৃতি অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তনে সংহত অনেক কাঠামোর ভিত নড়বড়ে। তাকে আরও সচেতন কর্মনিষ্ঠা আর দেশপ্রেমের গভীর চেতনায় ভিন্ন মাত্রা দেওয়াও বর্তমানের ন্যায্যতা।

অনেক জায়গায় এত গরমিল, অসঙ্গত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, যা দেশ শাসন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার আশঙ্কা থেকেই যায়। উন্নয়ন কর্মপ্রক্রিয়ায় হরেক নির্মাণাধীন প্রকল্প তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারার দৃশ্যও হতাশাব্যঞ্জক। সবচেয়ে দুঃসহ অবস্থা পার করছে মেধা ও মননের তীর্থস্থান উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ। সেখানে লেখাপড়ার সুষ্ঠু, সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নিতান্ত আবশ্যক।

কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে শরিক হন অগণিত শিক্ষার্থী। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকায় তাদের আবেদন, নিবেদন আর সমর্পণে জাতি যে অনন্য উপহার পেল, সেটা চিরস্মরণীয় এক গৌরবের অর্জন। এখন আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনন্য দায়বদ্ধতা তাদের অসমাপ্ত শিক্ষা পাঠক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। যেটি যৌক্তিক আর স্বস্তিকর পরিস্থিতি।

প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকেও ফিরে এসেছে কর্মচাঞ্চল্য। ভয়-ভীতি কাটিয়ে অগণিত শিক্ষার্থী তাদের মূল কার্যক্রমে ফিরে আসাও দেশের জন্য সর্বাধিক মঙ্গলজনক। তবে বিশ^বিদ্যালয়গুলো শিক্ষা পাঠক্রমকে কতখানি নিয়মানুগ করছে, সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। সরকার পতন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উপস্থিত, গুরুত্বপূর্ণ দাবি-দাওয়া পূরণ হয়েছে।

কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতির স্থিরতা আরও যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা জাতির মেরুদ-। তার ওপর যে কোনো আঘাত কিংবা বিপরীত অবস্থা তৈরি করা সঙ্গত নয়। আমাদের দুঃসাহসিক, নির্ভীক শিক্ষার্থী সমাজ দেশ ও জাতির অহঙ্কার। যথার্থ যোগ্যতায় আগামীর নতুন বাংলাদেশের হাল তাদেরই ধরতে হবে। নিজেদের জ্ঞানচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ ও সাবলীল সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশকে নিরন্তর এগিয়ে নেওয়াই হবে উদীয়মান নতুন প্রজন্মের অবশ্যম্ভাবী কর্মপরিকল্পনা। 

লেখক : সাংবাদিক

×